ইসরাইলি হামলায় ইরানের ৬ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত

ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে চালানো ইসরাইলের সামরিক হামলায় তেহরানের ৬ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। দেশটির গণমাধ্যম তাসনিম নিউজ এ খবর দিয়েছে।
ইহুদিবাদী সরকারের সামরিক হামলা সম্পর্কে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, এই হামলায় অন্তত ছয়জন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন, যাদের নাম-আব্দুলহামিদ মিনুচেহর, আহমদ রেজা জোলফাকারি, সৈয়দ আমির হোসেন ফেকহি, মাতলাবিজাদেহ, মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি এবং ফেরেইদুন আব্বাসি।
নিহত পরমাণু বিজ্ঞানীদের মধ্যে ফেকহি তেহরানের শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক প্রকৌশল অনুষদের সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার উপ-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
আরও পড়ুন
এর বাইরে নিহতদের মধ্যে পরামাণু বিজ্ঞানী মাতলাবিজাদেহর সঙ্গে তার স্ত্রীও এই হামলায় শহীদ হয়েছেন।
এছাড়া ইসরাইলের এই ভয়াবহ বিমান হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ হোসেন বাকেরি, ইসলামিক রেভোলিউশন গার্ড কর্পসের কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেন সালামি এবং ইরানের খাতাম আল-আম্বিয়া কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলাম আলী রশিদ নিহত হয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী ইহুদিবাদী সরকারকে কঠোর পরিণতি ভোগ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই অপরাধের জন্য ইহুদিবাদী সরকার নিজেদের জন্য একটি তিক্ত ও বেদনাদায়ক পরিণতি ডেকে এনেছে, যা তারা অবশ্যই দেখতে পাবে।’
ইরানে ‘‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’’ কেন চালানো হচ্ছে, এর লক্ষ্য কী?

ইরানে সামরিক অভিযান শুরু করেছে ইসরাইল। তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে শুক্রবার (১৩ জুন) চালানো হামলার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। এর লক্ষ্য ছিল তেহরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ‘হৃদয়’-এ আঘাত হানা।
হামলা চালানোর পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ভাষণে বলেন, ইরানের পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার হুমকি দূর করার জন্য ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ যত দিন প্রয়োজন তত দিন অব্যাহত থাকবে।
নেতানিয়াহু বলেন, ইসরাইল নাতানজে ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
তিনি বলেন, ইসরাইল ‘ইরানি বোমা তৈরি করা’ তেহরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানীদেরও আঘাত করেছে।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ কী?
শুক্রবার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত অভিযানের লক্ষ্য ছিল ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য ইরানি হুমকিকে প্রতিহত করা।
নেতানিয়াহু বলেন, অভিযানের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা এবং সামরিক সক্ষমতায় আঘাত করা।
তিনি বলেন, ‘আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই হুমকিগুলো রেখে যেতে পারি না। কারণ আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ না নিই, তাহলে আর কোন প্রজন্ম থাকবে না। যদি এখনই পদক্ষেপ না নিই, তাহলে আমরা এখানে থাকব না। ’
আরও পড়ুন
নেতানিয়াহু ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়ার সময় বলেন, ইরান ছয় বছরের মধ্যে ২০ হাজারটি এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করেছিল, তাই ইসরাইল সেগুলো অপসারণের জন্য অভিযান চালাচ্ছে। ’
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মতে, এটি ছিল প্রথম পর্যায়ের হামলা। প্রাথমিক হামলায় ইরানের বিভিন্ন এলাকায় পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তু সহ কয়েক ডজন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আইডিএফ সামনে এবং পেছনে অভিযানের জন্য মূল্যায়ন এবং প্রস্তুতির একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া পরিচালনা করছে।
এদিকে, জাতিসংঘে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন বলেছেন, ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র অবকাঠামোর বিরুদ্ধে অপারেশন ‘রাইজিং লায়ন’ শুরু করেছে, যার লক্ষ্য ইসরাইল এবং সমগ্র বিশ্বের নাগরিকদের জন্য একটি অস্তিত্বগত এবং তাৎক্ষণিক হুমকি দূর করা।
তথ্যসূত্র: অ্যাক্সিওস।
‘সিংহের লেজ’ ধরে টান মেরেছে ইসরায়েল

ইরানে হামলাকে ‘সিংহের লেজ নিয়ে খেলা’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে দেশটির পেজেশকিয়ান সরকার। বৃহস্পতিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘ইরানে যুদ্ধ শুরু করার অর্থ হচ্ছে সিংহের লেজ নিয়ে খেলা করা।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘কাপুরুষোচিত এই হামলা এসেছে ঠিক সেই মুহূর্তে যখন পারমাণবিক সমঝোতা নিয়ে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চলছিল। এটি প্রমাণ করে যে, দখলদার শাসনটি আসলে দুর্বল ও ভীত।’
‘ইরান বিগত দুইশ বছর কারো ওপর আক্রমণ শুরু করার ইতিহাস নেই। কিন্তু আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে তারা বিন্দুমাত্র পিছু হটেনি এবং হবেও না।’
‘ইরান ও এর জনগণের ওপর এই হামলা আবারও প্রমাণ করে যে দখলদার সরকারটি স্বভাবগতভাবেই অপরাধী ও সন্ত্রাসবাদী। নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে তারা যে দাবি করে যে তাদের হামলা সরকারকে লক্ষ্য করে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ইসরায়েল শুধু বলপ্রয়োগের ভাষাই বোঝে। তাই প্রত্যেক শহীদীর রক্তের বিনিময়ে উপযুক্ত প্রতিশোধ নেওয়া হবে।’
ইসরায়েলের হামলা : ইরানের পাশে দাঁড়াল সৌদি

ইরানে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরানের ওপর ইসরায়েলি হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। শুক্রবার (১৩ জুন) এক বিৃবতিতে সৌদি কড়া প্রতিক্রিয়া জানায়। খবর আলজাজিরার।
মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, সৌদি আরব এই জঘন্য হামলার নিন্দা জানায়। এটি নিশ্চিত যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং নিরাপত্তা পরিষদের এই আগ্রাসন অবিলম্বে বন্ধ করার বড় দায়িত্ব রয়েছে।
ইরানে পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তুসহ বিভিন্ন স্থানে হামলার পর সীমান্তে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে ইসরায়েল। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে দখলদাররা সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী প্রধান ইয়াল জামিরের বক্তব্যে যা স্পষ্ট।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী প্রধান বলেছেন- হাজার হাজার সৈন্যকে সীমান্তে একত্রিত করা হচ্ছে। এক টেলিভিশন ভাষণে ইয়াল জামির বলেন, সমস্ত সীমান্ত জুড়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে সেনাবাহিনী। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যে কেউ আমাদের চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করবে তাকে চরম মূল্য দিতে হবে।
জামির বলেন, হে ইসরায়েলের জনগণ, আমি নিরঙ্কুশ সাফল্যের প্রতিশ্রুতি দিতে পারি না। ইরানি সরকার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় আমাদের উপর আক্রমণ করার চেষ্টা করবে। আমাদের থেকে প্রত্যাশিত হামলা আরও ভয়াবহ হবে। আমরা আগে যা ব্যবহার করে হামলা করেছি এবার তার থেকে আলাদা কিছু করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। বাস্তব এবং বর্তমান হুমকির বিরুদ্ধে প্রস্তুতি অর্জনের জন্য সমস্ত শাখা এবং অধিদপ্তরে অভূতপূর্ব প্রচেষ্টা রয়েছে।
ইরানের পক্ষ থেকেও পাল্টা হুমকি আসছে। ইসরায়েলকে চরম মূল্য দিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুলফাজল শেখারচি।
আবুলফাজল শেখারচি বলেছেন, ইসরায়েল ইরানের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে আবাসিক ভবনও রয়েছে। এই হামলার জবাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাবে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল এই হামলা চালিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
ইসরায়েলে জরুরি অবস্থা জারি, নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশ

ইসরায়েলে পাল্টা হামলা শুরু করেছে ইরান। তেহরানসহ বেশ কিছু স্থানে পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ইসরায়েলের বিমান হামলার পর শতাধিক ড্রোন নিক্ষেপের মাধ্যমে ইরান এই হামলা শুরু করে।
হামলা ও পাল্টা হামলার এই উত্তেজনার মধ্যেই ইসরায়েলে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। এছাড়া ইরানের পাল্টা হামলার শঙ্কার মধ্যেই ইসরায়েলি নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার (১৩ জুন) পৃথকভাবে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম সিএনএন ও বিবিসি।
বিবিসি বলছে, ইরানে হামলার পরপরই নিজ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছে ইসরায়েলি সরকার। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “খুব শিগগিরই ইসরায়েলের ওপর পাল্টা হামলা” চালাতে পারে ইরান।
এছাড়া ইরানের ওপর যখন হামলা চালানো হয় ইসরায়েলের মানুষ তখন ঘুমাচ্ছিলেন। জেরুজালেমে অবস্থানরত একজন বিবিসি সংবাদদাতা জানিয়েছেন, সাইরেনের বিকট শব্দে এবং মোবাইলে জরুরি সতর্কবার্তা পেয়ে তারা জেগে ওঠেন।
অন্যদিকে সিএনএন বলছে, শুক্রবার ভোরে ইরানে হামলা চালানোর পর সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক আক্রমণের আশঙ্কায় ইসরায়েল সরকার নাগরিকদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে এবং নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইসরায়েলের হোম ফ্রন্ট কমান্ডের প্রধান মেজর জেনারেল রাফি মিলো বলেন, “এই অভিযান চলাকালে আমরা দেশে ব্যাপক সতর্কতা সংকেত বা সাইরেন বাজতে দেখতে পারি। তাই প্রত্যেক নাগরিককে অনুরোধ করছি— নিজ নিজ অবস্থান থেকে দ্রুত ও যথাসম্ভব সুরক্ষিতভাবে আশ্রয় নিতে।”
তিনি আরও বলেন, “আপনার বাসাবাড়িতে বা যে স্থানে আছেন, সেখানে যদি সুরক্ষিত কক্ষ, বাংকার বা হোম ফ্রন্ট কমান্ড অনুমোদিত নিরাপদ স্থান থাকে, তাহলে সেগুলোতে আশ্রয় নিন। তা না হলে অন্তত ভবনের সিঁড়িঘরে বা ভেতরের কোনও কক্ষে অবস্থান করুন।”
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী ও সরকার আগেই মনে করছিল, ইরানের পাল্টা হামলা যে কোনও সময় শুরু হতে পারে। তাই নাগরিকদের জন্য আগে-ভাগেই এই নির্দেশনা জারি করা হয়।
আর তাই ইরানের পাল্টা হামলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে সতর্ক সংকেত বাজানো শুরু হয় এবং নাগরিকদের জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়।
অবশ্য পরে ইরানের হামলা শুরু হওয়ার তথ্য জানিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র অ্যাফি ডেফরিন বলেন, “সকল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং এগুলো হুমকি প্রতিহত করতে কাজ করছে। এটি একেবারে ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি—আমরা কঠিন সময়ের মুখোমুখি হচ্ছি। তাই আমাদের ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।”
ড্রোনগুলো ঠিক কোথায় আঘাত হেনেছে বা প্রতিহত করা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়নি। তবে পরিস্থিতি যে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, সে বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য