ভ্যাট বৃদ্ধিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ

এইচ.এম. মশিউর রহমান: চারপাশে মানুষের জীবন যখন সার্বিক ভাবে বিপর্যস্ত। মানুষ যখন দুমুঠো আহারের জন্য হাড়-ভাঙা খাটুনির পরেও একপ্রকার হিমশিম খাচ্ছে। জীবনের কোন দিকদিগন্ত পাচ্ছে না। মানুষের ভাতের নিশ্চয়তা হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত ঠিক সেই মুহূর্তে সরকার মূল্য সংযোজন কর বৃদ্ধি করে মানুষের জীবন যাত্রাকে আরো বিপাকে ফেলে দিয়েছে। মানুষের এখন "মরার উপর খরার ঘা" অবস্থা। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে চারপাশের দরিদ্র মানুষের জীবন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে সাধারণ মানুষ শঙ্কা প্রকাশ করছে। মানুষের আশ্রয় বলতে আর কোন জায়গা থাকলো কই। মানুষের জন্য ভাবার আর মানুষ থাকলো কই। অন্তর্বতীকালীন সরকারের হঠাৎ করেই মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মানুষের দিশেহারা অবস্থা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপেই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধন আনতে যাচ্ছে সরকার। এতে তৈরি পোশাক, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, বিস্কুট, আচার, কয়েল ও টিস্যু পেপার, নন-এসি হোটেলসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে। ভ্যাট বাড়লে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে বাজেটের আগেই এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে পারে। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য। ইতোমধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে শুরু করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হতো।
এরই মধ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে আরেক দফা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র অবস্থা তৈরি হয়েছে। পোশাক, মিষ্টি, টিস্যু, এলপি গ্যাস, সস, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম ও গ্লাস, মোবাইল ফোনের কল রেট, ফল ও বিদেশ ভ্রমণের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক কর বৃদ্ধি ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। এতে মানুষের জীবন নির্বাহে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রভাব পড়ছে উৎপাদনেও। এর ফলে নিত্যদিনের খরচ আরও বেড়ে যাবে, দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।
সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সের জেরে জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষও এই ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপের কারণে কাহিল হয়ে পড়েছে। কারণ, মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ ব্যয় যখন বেড়েই চলছে, তখন সরকারের এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী বলে এরই মধ্যে বলা শুরু হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। সামনে পবিত্র রমজান মাস। ফলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এবারের রমজান মাসে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ও খরচ আরও বাড়বে। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেছেন, ‘যেসব পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে, তার কোনও প্রভাব পড়ছে না ক্রেতা পর্যায়ে। এর মধ্যে নতুন করে শুল্ক-কর বাড়ানোর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে। এই ব্যয় অন্তত ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে।’
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সরকারের ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর তালিকায় এমন অনেক পণ্যসেবা আছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’ তার মতে, বিরূপ প্রভাব শুধু গরিবের ওপরই পড়বে না, মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপরও চাপ পড়বে। এটা সাধারণ মানুষকে চাপের মধ্যে ফেলবে । তিনি বলেন, ‘সামর্থ্যবান অনেকেই সঠিকভাবে কর দেন না। সেখানে হাত দেওয়া উচিত ছিল।’
অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক আরোপিত কর ও ভ্যাট জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়াবে বলে মন্তব্য করেছে বিএনপিও। শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ সরকারের সিদ্ধান্ত ‘অপরিণামদর্শী’ অভিহিত করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে দলটি। রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপে সাধারণ মানুষের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেছেন।
তাহলে সকলেই যখন বুঝতে পারছে এবং অনুধাবন করছে যে এই মুহূর্তে ভ্যাট বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তাহলে উর্ধতনরা কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণকে বিপাকে ফেলে দিলো।
এই মূহুর্তে সরকারের অবশ্যই উচিৎ যে কোন বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বসাধারণ শ্রেণীর কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে নেওয়া । আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের মানুষ তারা কোন রকম দিন আনে দিন খেয়ে বেঁচে থাকে। এই মানুষ গুলোর জীবন অবস্থা সংকটে পড়েছে তাদের কথা চিন্তা করে যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের কাঁধে ভর করেই দেশ পরিচালিত হয়। আর সে জন্য যে কোন সিদ্ধান্তের আগে এই সকল মানুষের কথা চিন্তা করা সবচেয়ে জরুরি। তাদের কথা চিন্তা করেই যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাষ্ট্রের যে কোন সিদ্ধান্ত যেন জনগণ বান্ধব হয় এটা মাথায় রাখতে হবে সবার আগে।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।
গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া: শিক্ষার্থীদের জন্য স্বস্তি নাকি ভোগান্তি?

সামিহা তাসনিম: দেশের ২৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সমন্বিতভাবে মাত্র একটি পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্তে পড়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়ার জন্যই মূলত সূচনা হয় গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতির। এই ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিকে কেন্দ্র হিসেবে বাছাইপূর্বক যেকোনো জায়গায় পড়ার সুযোগ থেকে শুরু করে যাতায়াত খরচ ও সময়, শ্রম লাঘব করার জন্য আপাতদৃষ্টিতে একে শিক্ষার্থীবান্ধব হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। ক্রমাগত বেশকিছু অপরিকল্পিত ও এলোমেলো পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে দেশের সবচাইতে ত্রুটিপূর্ণ ভর্তি প্রক্রিয়া এটি, যার জন্য শিক্ষার্থীদের একটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
যথেষ্ট পরিকল্পিত না হওয়ায় গত তিনটি শিক্ষাবর্ষের তিন বারই বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় বাছাইয়ের নিয়মের পরিবর্তন করতে দেখা গিয়েছে। তাছাড়া মাইগ্রেশন পদ্ধতিটির সুষ্ঠু পরিচালনার অভাবে এটি দীর্ঘকালীন গড়ায়। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় শিক্ষাবর্ষে অন্যদের থেকে পিছিয়ে পরা সহ সেশনজোটের মত নানা সমস্যার। পূর্বের নিয়মের বরাবরই ব্যাতিক্রম, ফলে ব্যবস্থা নিয়ে জ্ঞানের সংকীর্ণতা থাকার কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ে পড়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। নানা সমস্যায় জর্জরিত হওয়ায় একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ও এখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। এই গুচ্ছ পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন বর্তমানে একান্ত জরুরী।
সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতির পুনর্গঠন করার বিকল্প নেই। পূর্বেই প্রক্রিয়ার সকল নিয়মাবলি নীতিমালা আকারে প্রকাশিত করতে হবে যেনো শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ পথ বিবেচনায় সম্পূর্ণ অবগত থাকতে পারে। মাইগ্রেশন কিংবা অপেক্ষামান তালিকা প্রকাশে কোনরূপ বিলম্ব না করে একে আরো দ্রুত অগ্রসর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভর্তি যুদ্ধ একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা তাই ভর্তি পদ্ধতি পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষার্থী ভোগান্তির সৃষ্টি হবে এরকম স্বার্থরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত হঠাৎই যেনো স্বায়িত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জোরপূর্বক চাপিয়ে না দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। যাতায়াত খরচের লাঘব ঘটলেও ভর্তি প্রক্রিয়া নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীর জন্য এখনো ব্যায়বহুল তাই আবেদন ফি সহ বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইমূলক ফি গুলোকে পুনরায় বিবেচনায় আনা উচিত। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি মাত্র ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলে, তা সব জায়গায়ই সর্বস্তরের মেধার শিক্ষার্থীদের ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। এরই প্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিক অহংকার কিংবা স্বনামধন্য আখ্যায়িত হবার মত অসুস্থ প্রতিযোগিতাগুলো বন্ধ হবে।
সর্বোপরি, শুধু ২৪টি নয়, ঢাবি, রাবি, জাবি, চবি সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে এক ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনার সুষ্ঠু ও পর্যাপ্ত পরিকল্পনা শিক্ষার্থীদের একাধিক ভর্তি পরীক্ষামূলক ভীতি, মানসিক চাপ হ্রাস সহ একটা দীর্ঘকালীন সময় ব্যায়ের পাশাপাশি অতিরিক্ত খরচ বাবদ সমস্যারও দূরীকরন ঘটাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
টিবি/
'বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি' নাম না হওয়ার দায় কার?

তৌফিকুল ইসলাম আশিক: গতকাল উপদেষ্টা পরিষদে ১৩ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত পাশ হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির নাম হয়েছে 'মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ'। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি নতুন নাম হবে 'বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি'। কেনো হলো না? কি সমস্যা!!
মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির শুরু থেকেই, প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া প্রতিটি স্টুডেন্ট এর মনের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা ছিলো ইশ ইউনিভার্সিটির নাম যদি 'বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি' হতো! বাংলাদেশের একমাত্র মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির নাম এটা চাওয়াই স্বাভাবিক। ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের পরেই সবাই এই নাম পরিবর্তনের দাবি জানায়। মূল ফটকে বঙ্গবন্ধুর নাম অপসারণ করে শিক্ষার্থীরাই।
মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি হয় ৩ সেপ্টেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের ১৭ দফা দাবিতে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। যা ছিলো মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির স্বাধীনতার বীজ রোপণ। সেখানে স্পষ্ট দাবি ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হবে 'বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি'। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য দায়িত্বভার গ্রহণ করেন নি। উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কমোডর মনির উদ্দিন মল্লিক, অন্যান্যদের সাথে নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করেন এবং নাম পরিবর্তনসহ সবগুলো দাবির ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন। মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ভদ্র তাই পরদিন থেকেই আবার সকল শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরে আসে সবাই। এ সময় আলোচনা হয় ___বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কমিটি করে, আলোচনা করে, সব সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্ত কিছুই হয় নি!
দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না দেখে____শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা একাধিকবার রেজিস্ট্রারের সাথে দেখা করলে নানান টালবাহানা শুরু হয়। যার মধ্যে অন্যতম নাম পরিবর্তন। এত এত শিক্ষার্থীদের দাবি, ৩ সেপ্টেম্বর সবার সামনেই 'বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি' নাম প্রস্তাব করার পরেও রেজিস্ট্রার কমোডর মনির উদ্দিন মল্লিক তার নিজের পছন্দ___ 'মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ' এ অটল থাকে। আমাদেরকে বলেন আবারো চিন্তা করতে। নানা যুক্তি দেখান। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজ এবং ওয়েবসাইট 'বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি' আপডেট করতে বলা হলেও করে নি (যেটি ৫ আগষ্টের পর 'মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ' করা হয়েছিলো)। উপরন্তু বাসের নতুন পেইন্টে নাম হয়___'মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ'। বিভিন্ন নথিপত্রে শুরু হয়েছিল মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ লেখা। পরবর্তীতে কিছু চাপের ফলে লেখা শুরু হয় বিএসএমআর মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। এমন, তার একক স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তেই চলছিলো সব কিছু। কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সঠিকভাবে চালাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। যার ফলাফল এই 'মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ'।
শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল সরকার পর্যায়ে নাম পরিবর্তনের জন্য চিঠি পাঠানো। যা পাঠানো হয় নি। এক্সকিউজ দেয়া হয় 'ইউজিসি থেকে মানা করা হয়েছে'। সরকার এই দায়িত্ব নিয়েছে। যতদূর জানি আগষ্ট সেপ্টেম্বরেই শেখ পরিবারের নামে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন কমিটি হয়েছে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে আন্দোলন, এতবার তার কাছে যাওয়া, কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেননি রেজিস্ট্রার। পাঠানো হয় নি নাম পরিবর্তনের চিঠি। এর মাঝে শিক্ষার্থীদের সাথে কয়েকবার অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করেন রেজিস্ট্রার। তিনি বলেন, আমি কি তোমাদের দাবি পূরণের জন্য সংবিধানে স্বাক্ষর করে এসেছি? আমি কি তোমাদের চাকর? আমার আর কোনো কাজ নেই। তোমরা বললেই আর হয়ে যাবে? এমন আচরণ করা শুরু করেন। জুলাই আগষ্ট অভ্যুত্থানের স্মরণে করা অনুষ্ঠান তার পরিকল্পনাহীনতা এবং অযোগ্যতার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ব্যক্তিগতভাবে এইসব বিষয় নিয়ে তার সাথে কথা বললে তিনি আমার আচরণ ছাত্রলীগের আচরণের সাথেও তুলনা করেছেন। যৌক্তিক দাবি আদায়ে কথা বলা কি ছাত্রলীগের আচরণ?
প্রায় চার মাস হয়ে গেলেও কোনো বিষয়ে কোনো সমাধান আসছিলো না। বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কমিটি করার কথা থাকলেও হয় নি শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি কমিটিও। শিক্ষার্থীদের ফি কমানোর কমটিতে রাখা হয় দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে। ২-৩ মাসেও সেমিস্টার ফি কমানোর কমিটি দিতে পারে নি প্রতিবেদন। এর মাঝে কাহিনীর শেষ নেই। অনেক অনেক প্রতিবন্ধকতা। সব হয়____দাবি আদায়ে নেই কোনো জোড়ালো কার্য্যক্রম। সর্বশেষ বাধ্য হয়ে উপাচার্য মহোদয়ের সাথে দেখা করতে গেলে সেখানেও এসে বাধা দেয় এই রেজিস্ট্রার কমোডর মনির উদ্দিন মল্লিক। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের সাথে বাকবিতণ্ডা হয় এবং সেদিন থেকেই ওনার সাথে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। উপাচার্য মহোদয়কে সব বিষয় জানানো হয়। তিনি আশ্বস্ত করেন। কিন্তু রেজিস্ট্রারের অসহযোগিতায় কোনো কিছুই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। আবারো আন্দোলন ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪।
এবারের আন্দোলন আরো জোড়ালো হয়। অবরোধ করা হয় মিরপুরের রাস্তা। অবশেষে উপাচার্য মহোদয় সবার সামনে এসে কথা বলেন, তিনি জানান অনেক বিষয় তাকে জানানো হয় নি। শিক্ষার্থীদের মন্তব্য_____এই না জানানোর দায়ভার রেজিস্ট্রারের। নিজের ইচ্ছে মতো অনেক বিষয় জানাননি উপাচার্য মহোদয়কে। উপাচার্য মহোদয় শিক্ষার্থীদের সাথে বসেন। বিভিন্ন বিষয়ে ইমিডিয়েট একশন নেন। ১৫ তারিখ আন্দোলন, ১৭ তারিখ উপাচার্য মহোদয়ের নির্দেশে চিঠি যায় ইউজিসিতে। এর আগে কোনো ধরনের চিঠি যায় নি। বিষয়গুলো পৌঁছায়নি জায়গা মতো।
নাম পরিবর্তনের এমন সিদ্ধান্ত শোনার সাথে সাথেই উপাচার্য মহোদয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে জোড়ালোভাবে শিক্ষার্থীদের প্রাণের চাওয়া 'বাংলদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি' ব্যাপারটা জানিয়েছেন। ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক অতিরিক্ত পরিচালককে জানানো হয়েছে। সব মিলে উপাচার্য মহোদয়ের উপর আস্থা রেখেছে শিক্ষার্থীরা। আশা করছি প্রজ্ঞাপন 'বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি' হয়েই আসবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় যথেষ্ট আন্তরিক। তিনি চেষ্টা করছেন সব যৌক্তিক দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার জন্য। কিন্তু উপাচার্য মহোদয়কে সঠিকভাবে সাহায্য করতে ব্যার্থ, আমাদের সবার প্রিয় রেজিস্ট্রার। আমরা মানি আপনি দেশের গৌরব নৌবাহিনীর একজন চৌকস কর্মকর্তা। কিন্তু প্রিয় রেজিস্ট্রার স্যার আপনি বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর জন্য যোগ্য না। না হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি তো এই জায়গাগুলোর মানুষ না। আবার এটা নৌঘাঁটিও না। যার স্থান যেখানে তাকে সেখানেই রাখা উচিত। একটি ভুলের কারণে এমন মাশুল দিতে হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে।
এখন আসি খুবই এল্যার্মিং একটা বিষয়ে, গতকাল উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ -এর ভেরিফায়েড ফেসবুক এ পোস্ট করা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে দেখা যায় কি? মেরিনেইম বিশ্ববিদ্যালয়। হতে পারে স্পেলিং মিসটেক। কিন্ত এই রেফারেন্স প্রথম সারির মিডিয়াগুলো রিপোর্ট করেছে। কারেকশন করে নি। কারন তারা জানে না 'মেরিটাইম' শব্দটা। আন্দোলনের দিন পুলিশ এসে বলে আপনি এই কলেজের স্টুডেন্ট? লজ্জা!! ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় 'মেরিটাইম' শব্দটা এখনো পরিচিত করাতে পারেনি। সবাইকে জানাতে পারে নি এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়। বোঝাতে পারেনি এটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটাই আমাদের আক্ষেপ।
কিন্তু কেনো এমনটা হলো? এর পেছনে দায়ী সিস্টেম। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, ট্রেজারার, ডিন, প্রক্টর, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, কিছু ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধান থেকে শুরু করে আরো গুরুত্বপুর্ন স্থানে রয়েছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তারা। নির্দ্ধিধায় বলতে পারি তারা যোগ্য কর্মকর্তা। দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষাই তাদের দায়িত্ব। স্যালুট তাদের। কিন্তু তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য আসেন মাত্র ৬ মাস কিংবা ১ বছরের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝে ওঠার আগেই, বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসা শুরু হতে হতেই তাদের আবার ফিরিয়ে নেয়া হয় নৌবাহিনীতে। কাজ শুরু করার আগেই শেষ। নৌবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু তাদের কাজ শুরু করার আগেই শেষ হয়ে যায়। অনেকেই তোড়জোড় শুরু করেন এখানে থেকে চলে যাওয়ার জন্য। যাই হোক এই সমস্যা সমাধান করা জরুরি। পাশপাশি যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন, অনেকেই মনের বিরুদ্ধে আসছেন। অনেকের সাথেই কথা হয়েছে তারা বলেন, তারা এখানের জন্য না। তারা জোর করেও আসেন নি। পাঠানো হয়েছে তাই।
আচ্ছা কেনো এমন? ব্লেন্ডেড সিস্টেম কি করা যায় না? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপ-উপাচার্য সিভিল থেকে দেয়া যায় না? ডিনগণ যেহেতু একাডেমিক বিষয় দেখেন তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে আসা অভিজ্ঞ মানুষরা হতে পারেন না? একটু ভাবতে হবে। শুধু ক্ষমতা ধরে রাখা না, বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করবো।
ঐযে মেরিনেইম লিখেছে, এক নামে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিকে সবাই চিনবে। সেই আইডিয়া আমাদের স্টুডেন্টদের কাছে আছে। এক নামে মেরিটাইম কে চিনবে সেই জন্য কাজ করতে হবে। ২০ লাখ টাকা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের Ranking কিভাবে হবে সেই প্রজেক্ট না করে, ২ লাখ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচারনায় ব্যয় করা অধিক কার্যকরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের Ranking এমনিতেই হবে যদি একাডেমিশিয়ানদের প্রাধান্য দেয়া হয়। শিক্ষকরা তাদের যোগ্য স্থান ও মর্যাদা পায়। তাদের গুরুত্ব দেয়া হয়। আর সকল ধরনের নিয়োগ বৈধভাবে হয়। আমাদের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই 'মেরিটাইম' শব্দটাকে চেনাতে হবে।
সর্বোপরি সবাইকে অনুরোধ করবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারের জন্য এক থাকতে। অনেকে অনেকভাবে ডিভাইড করার চেষ্টা করছে। সাময়িক ক্ষতির কথা না ভেবে সামগ্রিক ও দীর্ঘমেয়াদি বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষতির সম্মুখীন থেকে বাঁচানো আমাদের দায়িত্ব। এই বিশ্ববিদ্যালয়টা আমার, আমাদের। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের টাইটেল আমার ক্যারি করবো। যারা এখানে কাজ করছেন তাদের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি আমরা বিলং করি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করবো আমাকে বা আমাদেকে শত্রু ভাববেন না। আপনাদের সহযোগিতা করতে চাই। আপনারা আমাদেরকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যান।
বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসি। বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিকে এক নামে চিনুক সবাই। হোক একটা ব্র্যান্ড।
লেখক: শিক্ষার্থী, পোর্ট এন্ড শিপিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি
বিশ্ব জুড়ে ভূ-লণ্ঠিত মানবাধিকার!

মো: সবুজ হোসেন: আজ ১০ ডিসেম্বর,২০২৪ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। সর্বজনীন মানবাধিকার দিবস ঘোষণার ৭৬ বছর পূর্তির দিনটিতে আজ বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হবে। বিশেষ করে দেশে দেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অর্জন ও লঙ্ঘনের দিকগুলো যারা পর্যবেক্ষণ করেন তারা এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান মূল্যবান প্রতিবেদন প্রকাশ, তথ্য ও তত্ত্বকথা উপস্থাপন করেন, তাদের সবার কাছে দিনটি সবিশেষ গুরুত্ববহ। কিন্তু মানবাধিকার শুধুই প্রতিবেদন প্রকাশ,তথ্য ও তত্ত্বকথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ,, বাস্তবিক অর্থে এখনো পযর্ন্ত বিশ্বজুড়ে সুষম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি।
জাতিসংঘের সংজ্ঞা মতে, ''মানবাধিকার হলো মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সার্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার। মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য।''
বিশ্বব্যাপী প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা পত্রে ৩০ টি ধারা রয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে এই ঘোষণার ৭৬ বছর পার হয়ে গেলেও এখনো বিশ্ব ব্যাপী যে সুষম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। যেমন এই ঘোষণাপত্রের ধারা ৪ এ বলা হয়েছে, ''কাউকে অধীনতা বা দাসত্বে আবদ্ধ করা যাবে না। সকল প্রকার ক্রীতদাস প্রথা এবং দাসব্যবসা নিষিদ্ধ করা হবে"। কিন্তু মানব পাচার , শ্রম , যৌন শোষণ বা ক্রিয়াকলাপের উদ্দেশ্যে বলপ্রয়োগ বা প্রতারণার মাধ্যমে ব্যক্তিদের অবৈধ পরিবহন জড়িত আধুনিক দিনের দাসত্বের ধরন যেখানে অন্যরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়।ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে বিশ্বে পাচারের শিকার হওয়া মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও কিশোরী। প্রধানত যৌন ব্যবসা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়ার উদ্দেশ্যেই এদের পাচার করা হয়ে থাকে।প্রতিবেদনে আরো দেখা যায় যে , মানব পাচারকারীরা সারা বিশ্বেই নারী ও কিশোরীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে চলেছে। শনাক্তকৃত ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রায় তিন-চতুর্থাংশই যৌন নিপীড়নের সম্মুখীন হয়। এর পাশাপাশি ৩৫ শতাংশ নারীকে জোরপূর্বক শ্রমিক বানানো হয়। সাধারণত এইসব নারীদেরকে অনুন্নত দেশ থেকে দেশ থেকে যোগাড় করা হয় এবং পাচার করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে।
প্রতিটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে সম্মান ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বর্তমান বিশ্বে লক্ষ লক্ষ শিশু তাদের মৌল মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে সময়ে একটি শিশুর স্কুলের যাওয়ার কথা সে সময়ে সে কলকারখানা বা ইটের ভাটায় কিংরা টেনারিতে কাজ করছে।২০২৪সালের হিসাবে , বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলিতে, প্রায় পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন শিশু শ্রমে নিয়োজিত, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাব-সাহারান আফ্রিকায় বসবাস করে , যেখানে চারজন শিশুর মধ্যে একজনের বেশি নিযুক্ত রয়েছে। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে। এদের মধ্যে ৭০% শিশু কৃষিখাতে, ২০% সেবাখাতে, এবং ১০% শিল্পখাতে কর্মরত। ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে আছে, যাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্কুলের বাইরে। কোভিড-১৯ মহামারি এবং অর্থনৈতিক সংকটের পর এই প্রবণতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে, যার ফলে অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের শ্রমে নিযুক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে। আফ্রিকার মতো অঞ্চলগুলিতে পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।এছাড়াও কর্মস্থলে সে তার ন্যূনতম পারিশ্রমিকও পাচ্ছে না। এছাড়া পুষ্টি খাবার না খাওয়াতে সে অপুষ্টিতে ভুগছে। ২০২৪ সালের ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু অপুষ্টির কারণে গুরুতর খাদ্য সমস্যার সম্মুখীন। এটি প্রায় ১৮১ মিলিয়ন শিশুকে বোঝায়, যারা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে না।
বর্তমানে বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ মানবেতর পরিবেশে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। যেমন ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজের দেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের আশ্রয় নেয়।বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবনযাপন করছে, বিশেষ করে শিশু ও নারীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার। শিবিরগুলোতে নিরাপত্তা, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা অপ্রতুল।এছাড়া মানবপাচার ও যৌন হয়রানির ঝুঁকিও এই জনগোষ্ঠীর জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যার ৭ বছর পেরিয়ে গেলোও এর সুষ্ঠু কোনো সমাধান দিতে পারে নি মানবাধিকার সংস্থা গুলো। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কোনো প্রস্তাব আনা হলেই ভেটো ক্ষমতার অধিকারী দেশ গুলো ভেটো প্রদান করার ফলে এই সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট হচ্ছে:যুদ্ধ এবং সংঘাত। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইজরায়েল ও ফিলিস্তিন সংকট।১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই সংকটের সূচনা হয় যা এখন পযর্ন্ত বিদ্যমান রয়েছে। এর মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে ইজরায়েলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিন নিজেদের মাতৃভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়ে এবং নিজের ভূমি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু বিশ্ব মোড়লরা এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বরং এই সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের রূপ নিয়েছে। গত অক্টোবরের শুরুর দিকে হামাসের আকস্মিক হামলায় ১,৪০০-এর বেশি ইসরায়েলি নিহত হন এবং বহু মানুষ আহত হন। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এতে প্রায় ৪,৩৮৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ১০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। গাজায় খাদ্য, পানি ও ওষুধের চরম সংকট দেখা দিয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ইসরায়েলি হামলায় বহু শিশুও নিহত হয়েছে, এবং গাজার হাসপাতালগুলোতে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এই অবস্থাকে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। রাফাহ সীমান্ত দিয়ে কিছু ত্রাণ সরবরাহ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
এই সংঘাত বন্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত স্থায়ী সমাধান দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে এবং আরও প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে।
রাশিয়া- ইউক্রেন এর মধ্যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে অনুন্নত দেশগুলো তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে এছাড়া যুদ্ধের ফলে যানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া সিরিয়া, ইয়েমেন ও সুদানের মতো দেশে যুদ্ধের ফলে ব্যাপক বেসামরিক ব্যক্তি নারী, শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, যা মানবাধিকারের পরিপন্থী।
যে উদ্দেশ্যে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা করা হয়েছিল এই বৈষম্যহীন মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলা, সেই লক্ষ্য অর্জনে এই ঘোষণাপত্র ব্যর্থ হয়েছে।এই ঘোষণাপত্রকে সফল করে তোলার জন্য বিশ্ব মোড়লদের এগিয়ে আসতে হবে, কারণ হাতেই এই সমস্যা সমাধান করার চাবিকাঠি রয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে এগিয়ে আসতে হবে এই ঘোষণাপত্র সফল করার জন্য। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে তোলা সম্ভব মানবিক পৃথিবী এবং পূরণ করা সম্ভব সব ব্যক্তি মানবাধিকার।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও করনীয়

এইচ. এম. মশিউর রহমান: সারা দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে যে চিত্র দেখতে পাই সে দৃশ্য আমাদের সবার মনেই এক ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাবে প্রভাবিত করে। সমগ্র দেশজুড়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন অবনতির তলানীর দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানুষ আতঙ্কে মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা আর স্বাভাবিক নেই।। মানুষের জীবন আতঙ্কে ক্রমাগত দূর্বিষহ হয়ে উঠছে।
সম্প্রতি ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি দোকানে অস্ত্রধারীরা ঢুকে ডাকাতি ও এক তরুণীকে চাপাতি হাতে দৌড়ানোর ঘটনাসহ একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনার পর এলাকাবাসীর বিক্ষোভের পর সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৪৫ জনকে আটক করা হয়েছে।
ঢাকাসহ কয়েকটি এলাকার অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম এবং প্রকাশ্যে চাপাতি রামদা নিয়ে আক্রমণ কিংবা দৌড়াদৌড়ির মতো বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে।
বিশেষ করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে একদল তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে ধরে টানা হেঁচড়া করছে, ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে আর তরুণী দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন বা মিনি সুপারশপে চাপাতি হাতে কয়েকজন ঢুকে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলছে- এমন দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছে মানুষ।
সাম্প্রতিক এই দুটি ঘটনাই মোহাম্মদপুর এলাকার। ওই এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ইব্রাহীম খলিল বলছেন, পাঁচই অগাস্টের পর কয়েকদিন ছিলো ডাকাতির আতঙ্ক আর এখন কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে দলবদ্ধ ভাবে কিশোর তরুণরা ঘুরাঘুরি করছে, একে ওকে হামলা করছে এবং ভয়ে তাদের কেউ কিছু বলতে পারছে না।
ফয়েজুর মোল্যার বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর এলাকায়। তেলের পাম্পে গাড়ি চালিয়ে সংসার চালান ফয়েজুর পাশাপাশি গরু পালন করেন তিনি। সকালে দেখে খামারে একটা গরুও নাই। তিনি বলেন ঋণের টাকায় গরু কিনে পাইলে-পুইষে বড় বানালাম। চোরেরা গরুগুলো নিয়ে আমারে পথে বসায় দিয়ে গেল। পাম্পের গাড়ি চালাইয়ে যা আয় করতাম, তা দিয়ে খাইয়ে-পইরে বাকি সব খরচ করতাম ওই গরুর পিছনে। চার বছর ধরে কষ্ট করে বানানো খামারডা ধ্বংস করে দেল। আমারে একেবারর পঙ্গু কইরে দিয়ে গেল।’
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নের চর এলাকায় মা ও মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। নীলফামারীর সৈয়দপুরে ক্ষুদ্রঋণের ২৫ হাজার টাকা নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হতেই ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক ব্যক্তি।
ফরিদপুর শহরের ব্রাক্ষ্মণকান্দা এলাকায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে কনস্টেবলসহ দুজনকে পিটুনি দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই করতে রিফাত মিয়া নামের অটোরিকশাচালককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
এছাড়া গত পাঁচই অগাস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুলিশি ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে চলছে। সারাদেশে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতির মতো মারাত্মক অপরাধ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অপরাধের বিবরণ ও ধরন এমন যে কোনো সুস্থ্য এবং বিবেকবান মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। গা শিউরে উঠা একেকটি ঘটনা মানুষের মনোজগতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। একশ্রেণীর মানুষের বর্বরতা ও নৃশংসতা মধ্যযুগকেও হার মানাচ্ছে। কোনোভাবেই যেন এই নিষ্ঠুরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এসব ঘটনার গ্রাফ ক্রমেই উর্ধ্বমুখী। আইন তার যথার্থ কার্যকারিতা হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সর্বময় ভয়ের রাজত্ব। মানুষ কোথাও শান্তিতে তাদের স্বাভাবিক কাজ সম্পাদন করতে পারছে না। সবার মনে এক অদৃশ্য আতঙ্ক।
আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি দ্রুত মানুষের মনের এই আতঙ্ক দূর করতে সক্ষম না হয়ে উঠতে পারে তাহলে মানুষ ধীরে ধীরে তাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা থেকে দূরে ছিটকে পড়বে। যার ফলস্বরূপ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও অন্যান্য সকল সেক্টরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেই কারণে এই মুহুর্তে সকলে মিলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে এলাকাভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেয়া দরকার। সমাজের বিশিষ্টজনদের সাথে নিয়মিত বৈঠক ও আলাপ-আলোচনা করে দিক নির্দেশনা দেয়া উচিত। সংশ্লিষ্ট থানা এলাকায় কারা কোন অপরাধের সাথে জড়িত তার তালিকা নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে। এ তালিকা ধরে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। অপরাধী যেই হোক, তাকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ অটুট রাখতে এবং অবক্ষয় ঠেকাতে এলাকার অভিভাবকদের সক্রিয়া হওয়া বাঞ্চনীয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যর আচার-আচরণের দিকে অভিভাবকদের যথাযথ দৃষ্টি রাখতে হবে। তবেই আমরা এই মুহূর্তের এই অরাজক পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবো বলে আশা রাখি।
লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।
মন্তব্য