রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
শামুকের ‘অজানা জগৎ’ উন্মোচনে রাবির গবেষণায় সাফল্য

‘প্রকৃতির মুক্তা’ খ্যাত বিলুপ্তির মুখে থাকা গেছো শামুকের (অ্যামফিড্রোমাস গ্লোবোনেভিল্লি) প্রজনন বিষয়ে বিশ্বে প্রথমবারের মতো এক অভিনব আচরণ শনাক্ত করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গবেষকরা। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রজাতিটি সম্পূর্ণরূপে গাছে বসবাস ও প্রজনন করে থাকে। বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে বিস্তৃত অ্যামফিড্রোমাস প্রজাতির শামুকের ক্ষেত্রে এটাই প্রথমবারের মতো ডিম পাড়ার প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।
সম্প্রতি এই আবিষ্কারটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ফোলিয়া মালাকোলজিকা (Folia Malacologica)-তে প্রকাশ পেয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার জীববৈচিত্র্য গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় ৫ দিনব্যাপী পরিচালিত মাঠ পর্যায়ের জরিপে এটি দেখা গেছে।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেন রাবির মলাস্কান রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শাহরিয়ার শোভন এবং নেদারল্যান্ডস-এর ভ্রিজে ইউনিভার্সিটি (VU)-এর ড. তাকুমি সাইতো। দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন—মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা টি এস রূপময় তঞ্চঙ্গ্যা, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের দুজন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. রহিম বাদশা ও মো. জায়িদ হাসান।
গবেষণায় উঠে এসেছে, অ্যামফিড্রোমাস গ্লোবোনেভিল্লি নামক গেছো শামুকটি গাছের ছোট ছোট গহ্বরে ১০ থেকে ৫০টি করে গোলাপি-সাদা ডিম পাড়ে। একই সাথে, কিছু ডিম শামুকের খোলসে লেগে থাকতে দেখা গেছে এবং কিছু ডিম গহ্বরের বাইরেও দৃশ্যমান ছিল। এই অভিনব আচরণ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, শামুকটির পুরো জীবনচক্রই গাছেই সম্পন্ন হয়, যা আগে কোথাও নথিভুক্ত হয়নি।
এছাড়া শুধু আম গাছ নয়, কাঁঠালসহ অন্যান্য বৃক্ষেও এরা ডিম পাড়ে বলে গবেষকরা ধারণা করছেন। পূর্ববর্তী গবেষণায় যেখানে পাতার নিচে নেস্ট তৈরি করে ডিম পাড়ার তথ্য ছিল, এবার তা পরিবর্তন করে গাছের গহ্বরে ডিম পাড়ার আচরণ ধরা পড়েছে।
গবেষণায় সহযোগী প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. রহিম বাদশা (সোহান) জানান, ‘বাংলাদেশে ফিল্ড-ভিত্তিক গবেষণা এখনো সীমিত; বেশিরভাগ গবেষণা কেবল প্রকাশনা ও ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরে কেন্দ্রীভূত। এই ধারা ভেঙে শাহরিয়ার শোভন স্যার জাপানি কোলাবরেটরের সহযোগিতায় বিরল প্রজাতির শামুক নিয়ে গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। ইতোমধ্যে পাঁচটি নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং একটি অনন্য আচরণগত পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে। আরও গবেষণা ও প্রকাশনা প্রক্রিয়াধীন। তবে ফান্ডিংয়ের অভাবে এমন উদ্যোগ ব্যাহত হতে পারে। তাই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যথাযথ অর্থায়ন অত্যন্ত জরুরি।’
এ বিষয়ে প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহরিয়ার শোভন বলেন, ‘বিশ্বে এ ধরনের শামুকের প্রজাতি অত্যন্ত বিরল। এটি খুবই চ্যালেঞ্জিংও বটে, অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতির গহ্বরে বিপুলসংখ্যক ডিম একসঙ্গে রাখা। আমরা পাঁচজন গবেষক মিলে এই গবেষণাটি সম্পন্ন করেছি। গেছো শামুকের প্রজনন আচরণ সংক্রান্ত এই প্রামাণ্য তথ্য সংরক্ষণনীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি, দক্ষিণ এশিয়ার স্থলচর গ্যাস্ট্রোপডের আচরণগত বিবর্তন ও বাস্তুতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য চিহ্নিত করতেও এটি সহায়ক হবে।’
প্রসঙ্গত, প্রফেসর শোভনের নেতৃত্বাধীন মলাস্কান রিসার্চ ল্যাবরেটরি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে গেছো শামুকের পাঁচটি নতুন প্রজাতি শনাক্ত করেছে এবং বিশ্বের প্রথম সফল কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাও সম্পন্ন করেছে, যা এই বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর সংরক্ষণে যুগান্তকারী অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবিতে বাকৃবির প্রশাসনিক ভবনে তালা, অবরুদ্ধ উপাচার্য

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কম্বাইন্ড ডিগ্রির (বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি) দাবিতে প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদের শিক্ষার্থীরা।
বুধবার (৬ আগস্ট) বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে তারা প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগান। এতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া প্রশাসনিক ভবনের ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবিতে টানা সাতদিন ধরে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বাকৃবির পশুপালন অনুষদের শিক্ষার্থীরা। এবার তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীরাও।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে বুধবার দুপুর সাড়ে ৩টায় পশুপালন অনুষদের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
এ সময় তারা স্লোগান দেন 'আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই', `দাবি একটাই, কম্বাইন্ড ডিগ্রি চাই', `এক পেশা, এক ডিগ্রি, এক দাবি', কম্বাইন্ড! কম্বাইন্ড!'
পশুপালন অনুষদের ৫০১ জন শিক্ষার্থী কম্বাইন্ড ডিগ্রির পক্ষে স্বাক্ষরসংবলিত একটি তালিকা উপাচার্যের কাছে জমা দেন। একই দাবিতে পৃথকভাবে মিছিল করেছে ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীরাও। পরবর্তীতে দুই অনুষদের শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে একত্রিত হয়ে একযোগে স্লোগান দিতে থাকেন। পরে ভেটেরিনারি অনুষদের পক্ষ থেকে অনুষদের ডিন বরাবর লিখিত স্মারকলিপিও জমা দেওয়া হয়।
বিকেল ৪টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসেন। আলোচনায় উপাচার্য বলেন, “আমি এককভাবে সম্মিলিত ডিগ্রি চালুর সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। এ বিষয়ে একাডেমিক কাউন্সিলসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
তবে আলোচনায় আশানুরূপ অগ্রগতি না থাকায় বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনে তালা দেন। এসময় উপাচার্যের কার্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটি বৈঠক চলছিল। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শিক্ষার্থীরা তালা খুলে দেন।
আন্দোলনকারী এক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের এই যৌক্তিক আন্দোলনের সাথে ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হয়েছেন। আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা এবং পেশাগত মর্যাদার স্বার্থেই আমরা এক হয়েছি। শিক্ষকরা আমাদের দাবি শুনেছেন, আগামীকাল আলোচনা হবে—সেখানে আশানুরূপ সিদ্ধান্ত না এলে আন্দোলন আরও বেগবান হবে।
এ বিষয়ে বাকৃবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আসাদুজ্জামান সরকার বলেন, “পশুপালন অনুষদের শিক্ষার্থীদের কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবির প্রেক্ষিতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় ফ্যাকাল্টি মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আলোচনায় বসবেন এবং দাবিগুলো উপস্থাপন করা হবে। সবদিক বিবেচনায় রেখে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হবে।
ববি শিক্ষার্থীদের চোখে জুলাই বিপ্লবের এক বছর: প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

২০২৪ সালের জুলাই মাস, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন দ্রুতই ফ্যাসিবাদবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে জমা হওয়া ক্ষোভ, হতাশা আর বঞ্চনা রূপ নেয় অপ্রতিরোধ্য প্রতিরোধের। এক বছর পর, আজ ২০২৫ সালের আগস্টে দাঁড়িয়ে সেই আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ফিরে তাকাচ্ছেন—কতটা বদলেছে বাস্তবতা, কতটা পূরণ হয়েছে তাঁদের স্বপ্ন?
'আমরা শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারিনি'
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সুজয় শুভ এই আন্দোলনকে দেখছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি জাতির চিরায়ত সংগ্রামের অংশ হিসেবে। তাঁর ভাষায়, "১৯৭১ সালে পাকিস্তানি নিপীড়ন, এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেমন লড়াই হয়েছে, তেমনি ফ্যাসিস্ট হাসিনার সতেরো বছরের নিপীড়নের বিরুদ্ধেও এই আন্দোলন।" তিনি জুলাই অভ্যুত্থানকে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, "এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের সমস্ত প্রত্যাশা পূরণ হবে, এমনটা না। দুঃখজনক বিষয় হলো, আমরা শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজটি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পারিনি।" তিনি বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে একাগ্রতার অভাব নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
'যে স্বপ্ন নিয়ে রাজপথে নেমেছিলাম, তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই'
আন্দোলনের সম্মুখ সারির যোদ্ধা সাজ্জাদ হোসেনের মূল লক্ষ্য ছিল একটি দুর্নীতিমুক্ত ও সুশাসিত দেশ গড়া। তিনি বলেন, "আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, আমাদের আত্মত্যাগ একটি নতুন ভোরের সূচনা করবে।" কিন্তু এক বছর পরেও দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখতে না পেয়ে তিনি হতাশ। সাজ্জাদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে আজও সেই পুরনো জীর্ণতা বিদ্যমান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতার অভাব, প্রশাসনে দীর্ঘসূত্রিতা এবং দুর্নীতির অভিযোগ তাঁকে হতাশ করে। তিনি সরকারের কাছে জোর দাবি জানান, জুলাই আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে শিক্ষা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হোক। তাঁর প্রত্যাশা, "আমরা দেখতে চাই, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে এসেছে, যেখানে মেধা ও যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি।"
'এটি ছিল দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলে জমা হওয়া গণ-বিস্ফোরণ'
আন্দোলনের আরেক সংগঠক এবং জুলাইয়ে আহত মোকাব্বেল শেখ বলেন, "সফল জুলাই অভ্যুত্থান কোনো পরিকল্পিত বিপ্লব নয়। এটি দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলে জমা হওয়া একটি গণ-বিস্ফোরণ।" তাঁর প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশে একটি কাঠামোগত স্থায়ী পরিবর্তন আসবে, যা স্বাধীনতার পর কখনোই আসেনি। তবে তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আশানুরূপ পরিবর্তন দেখতে পাননি। অব্যবস্থাপনা, বৈষম্য আর দুর্নীতি এখনো অনেকাংশে রয়ে গেছে। মোকাব্বেল আশা করেন, জুলাইয়ের মাধ্যমে যে বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছে, তা একদিন এদেশের মানুষের চূড়ান্ত মুক্তির মাধ্যমে শহীদদের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ তৈরি করবে।
'আমার শরীরে ৫১টি স্প্লিন্টার লেগেছিল'
জুলাই বিপ্লবে গুলিবিদ্ধ হাসনাত আবুল আলা এই আন্দোলনকে "স্বাধিকার ফিরে পাওয়ার আপসহীন সংগ্রাম" হিসেবে বর্ণনা করেন। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ ছিল এই বিপ্লব। তিনি স্মরণ করেন ১৬ জুলাইয়ের সেই বিভীষিকাময় দিন, যখন আবু সাঈদ, শান্ত, ওয়াসিমসহ ছয়জন শহীদ হন। ৪ আগস্ট বরিশাল হাতেম আলী কলেজের সামনে পুলিশের স্প্লিন্টার হামলায় তাঁর মাথায়, বুকে, হাতে ও চোখে মোট ৫১টি স্প্লিন্টার লাগে। সেই যন্ত্রণা ও ত্যাগের পর ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়।
হাসনাতের মতে, এত আত্মত্যাগের পরেও জুলাই বিপ্লবের এক বছর পেরিয়ে গেলেও জুলাই ঘোষণা ও সনদ মেলেনি। গণহত্যার দায়ে জড়িতদের বিচার কার্যক্রমও দৃশ্যমান নয়। জুলাই যোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা তাঁকে ব্যথিত করে। তিনি বলেন, "এখনো নির্বিচারে মানুষ খুন হয়, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি মানুষকে অতিষ্ঠ করে রাখছে।" অসংখ্য অসংগতির মাঝেও তিনি একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশা করেন, যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে এবং শহীদদের চেতনা রক্ষিত হবে।
জুলাই আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই ভাবনাগুলো স্পষ্ট করে যে, এটি কেবল একটি কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছিল না, ছিল একটি জাতির অধিকার ও আত্মমর্যাদার পুনর্জাগরণ। সব দাবি হয়তো এখনও পূরণ হয়নি, কিন্তু যা জন্ম নিয়েছে তা হলো প্রতিরোধের এক নতুন ভাষা। ভবিষ্যৎ হয়তো আরও কঠিন, কিন্তু এই আন্দোলন যে স্বপ্ন আর প্রেরণার জন্ম দিয়েছে, তা সহজে থামার নয়।
চবির স্বাস্থ্যসেবা ‘নামমাত্র’, ২টি অ্যাম্বুলেন্সে চলে ২৯ হাজার

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থী এবং তিন হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তার স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব রয়েছে মাত্র দুটি অ্যাম্বুলেন্সের ওপর। ক্যাম্পাসে জরুরি চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দুটি অ্যাম্বুলেন্স সচল অবস্থায় রয়েছে এবং সেগুলো দিয়ে সার্বক্ষণিক সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে ক্যাম্পাসের পরিধি এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় এই সংখ্যাটি অত্যন্ত অপ্রতুল হওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসা ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পেতে অনেক সময়ই ভোগান্তিতে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা।
নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিব বলেন, “গুরুতর অসুস্থ হয় কেউ যখন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য কল দেয় তখন সেখান থেকে বলা হয় একটি শহরে আছে এবং আরেকটি ডাক্তার আনতে চলে গেছে। এসব হয়রানিমূলক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে অতি দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা বাড়াতে হবে।"
মোহাম্মদ আল আমিন নামে এক শিক্ষার্থী তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন,"সকাল ৬টার দিকে পেটব্যথায় অসুস্থ রুমমেটকে মেডিকেলে নিতে অ্যাম্বুলেন্সে কল দেই। জানানো হয়, দুটি অ্যাম্বুলেন্সই শহরে। বাধ্য হয়ে রুমমেটকে হেঁটে জিরোপয়েন্ট পর্যন্ত নিয়ে যাই, সেখান থেকে রিকশায় করে মেডিকেলে পৌঁছাই ৬:২৫ মিনিটে।"
এ এফ রহমান হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র দুটি অ্যাম্বুলেন্স, তাও সব সময় পাওয়া যায় না। কল দিলেই বলে এম্বুলেন্স দুটোই শহরে আছে। কিছুদিন আগে আমার হলে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তাকে দ্রুত মেডিকেল নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স কল দেওয়া হয়। এই এম্বুলেন্স আসতে দেরি করায় পরবর্তীতে আমরা তাকে মোটরসাইকেলে করে মেডিকেল নিয়ে যেতে বাধ্য হই।"
নাট্যকলা বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন," প্রথমত অ্যাম্বুলেন্স হচ্ছে অপর্যাপ্ত, তার উপর অ্যাম্বুলেন্স এর ভেতরের যে অবস্থা সেখানে অসুস্থ রোগী আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে"।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, হঠাৎ দুর্ঘটনা, সাপের কামড় কিংবা অসুস্থতার সময় অনেকেই মেডিকেলে পৌঁছাতেই দেরি করেন। অনেক সময় রিক্সা বা মোটরসাইকেলে করে রোগীকে নিয়ে যাওয়া লাগে। তাও আবার সব সময় পাওয়া যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. আবু তৈয়ব বলেন, দুটি অ্যাম্বুলেন্স সচল রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীসংখ্যা বিবেচনায় আরও একটি অ্যাম্বুলেন্স জরুরি। আমরা সে অনুযায়ী প্রশাসনকে প্রস্তাব দিয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য(প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, " আমাদের মেডিকেল সেন্টারের মৌলিক সমস্যা গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সের সমস্যা। এটি আমাদের দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই সমস্যা আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা এখনও এই সমস্যাটির সমাধান করতে পারিনি। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। আশা করছি অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের টাকা ছাড় হবে এবং একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনতে পারবো। আমাদের সাথে যেসব ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম রয়েছে আমরা তাদেরকেও অ্যাম্বুলেন্সের জন্য চিঠি দিয়েছি এবং অনুরোধ করেছি। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের এই সমস্যাটির সমাধান করার জন্য।
দেশের অন্যতম বৃহৎ এই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য এই সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাসেবা আরও আধুনিক ও দ্রুতগামী করতে মেডিকেল সেন্টারকে সম্প্রসারণ এবং অ্যাম্বুলেন্স সেবাকে শক্তিশালী করার দাবি জানাচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
জাবিপ্রবিতে ফল বিপণন উৎসব: হাতে-কলমে শিখছে ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনা

‘সঠিক বিপণন, উন্নত ব্যবস্থাপনা—ফল চাষে আসুক নতুন প্রভা’ এই স্লোগান নিয়ে জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবিপ্রবি) অনুষ্ঠিত হলো ব্যতিক্রমী এক ফল বিপণন ও ব্যবস্থাপনা উৎসব।
বুধবার (৬ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সবুজ চত্বর মুখরিত হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের এই ব্যতিক্রমী বিপণন প্রয়াসে। দিনব্যাপী এই উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান। এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসেন, রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ নূর হোসেন চৌধুরী এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান মো. এনামুল হক।
ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক আতিকুর রহমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় বিভাগের চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তাদের ‘মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট’ কোর্সের অংশ হিসেবে এই উৎসবের আয়োজন করে। তত্ত্বীয় জ্ঞানের সঙ্গে ব্যবহারিক শিক্ষার সংযোগ ঘটানোর লক্ষ্যে আয়োজিত এই উৎসবে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এর আগেও প্রভাষক আতিকুর রহমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৃক্ষরোপণসহ বিভিন্ন বাস্তবমুখী শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রশংসিত হয়েছেন।
উৎসবে ‘ফ্রুটি ফ্যাশন’, ‘ফলের বারান্দা’ এবং ‘বিজনেস থটস’ নামের তিনটি স্টল সাজিয়ে বসেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি স্টলেই ছিল ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি, বারি মাল্টা, ক্যারামবোলা, কাঁঠাল, আম ও পেয়ারার মতো ২০ থেকে ৪০ প্রকারের দেশি-বিদেশি ফলের সমাহার। শুধু তা-ই নয়, ফলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে তুলে ধরতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তৈরি করে এনেছিল নানা পদের আচার, জ্যাম, জেলি এবং স্বাস্থ্যকর পানীয়। ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে প্রতিটি স্টলেই ছিল বিশেষ ছাড় এবং আকর্ষণীয় অফার।
বিভাগের শিক্ষার্থী ও ফলের বারান্দা স্টলের সদস্য দৌলাতুন নেছা বলেন, ‘কনজুমারের সাথে স্মার্টলি কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ। বিক্রির সময় হাসিমুখে যোগাযোগ করা, পণ্যের ভালো দিকগুলো তুলে ধরা – এগুলো বিক্রয় বাড়াতে সাহায্য করেছে। টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ ভাগ করে নেওয়াটা খুব কার্যকর ছিল। আজ বুঝেছি মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট শুধু পণ্য বিক্রি নয়, বরং ক্রেতার আস্থা অর্জন করাও জরুরি। গ্রাহকের চাহিদা বুঝে সঠিকভাবে সেবা দেওয়া এবং সুন্দরভাবে প্রেজেন্টেশন করা বিক্রয়ের মূল চাবিকাঠি। ভবিষ্যতে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে
পারবো।’ এই গ্রুপের আরেক সদস্য সাজ্জাদ হোসেন জানান, ‘এই ফল বিপণন অনুষ্ঠান থেকে আমরা বইয়ের বাইরের অনেক কিছু শিখেছি। এখানে হাতে-কলমে শিখেছি কিভাবে উদ্যোক্তা হওয়া যায় এবং সীমিত সম্পদ দিয়ে বাজার তৈরি করা যায়। শিক্ষকরা শুধু পড়াননি, বাস্তব জীবন বুঝিয়েছেন। বুঝতে পেরেছি দেশীয় ফল বাজারজাত ও রপ্তানির মাধ্যমে কৃষক আর দেশের অর্থনীতি—দুটোতেই অবদান রাখা যায়।’
আয়োজনের সভাপতি ও প্রভাষক আতিকুর রহমান বলেন, “এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে ব্যবসা ও বিপণনের শিক্ষা দেওয়া। শ্রেনী কক্ষে যা শেখানো হয়, তার বাস্তব প্রয়োগ তারা এখানে করতে পারছে। ভবিষ্যতে তারা যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবে বা নিজেরাই উদ্যোক্তা হবে, তখন এই অভিজ্ঞতা তাদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।”
শিক্ষার্থীদের এমন সৃষ্টিশীল ও বাস্তবধর্মী উদ্যোগে সন্তোষ প্রকাশ করেন অতিথিরা। দিনভর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিপুল উৎসাহে স্টলগুলো পরিদর্শন করেন এবং ফল ও ফলের তৈরি বিভিন্ন পণ্য কিনে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেন।
মন্তব্য