অধ্যাপক ড. মো সাইদুর রহমান: বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণের কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত গ্রাজুয়েট তৈরির মাধ্যমে জ্ঞানের বিতরণ হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দই গ্রাজুয়েট তৈরির মূল কারিগর তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শিক্ষা কার্যক্রমে সহায়ক শক্তি হিসেবে গ্রাজুয়েট তৈরিতে ভূমিকা পালন করে। প্রধানত: দেশ-বিদেশের মানব সম্প্রদায়ের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নের জন্য নিয়োগকারীদের চাহিদা মোতাবেক গ্রাজুয়েট তৈরি করা হয়ে থাকে। মোট কথা, দেশ ও দেশের মানুষের প্রয়োজনের নিরিখেই গ্রাজুয়েট তৈরি করা উচিৎ।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকগণ যে জ্ঞান বিতরণ করে থাকেন তা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিষয়সমূহে ডিগ্রি প্রদান করা হয় তার কোর্স-কারিকুলা দ্বারা নির্ধারিত। শিক্ষকগণ তাঁদের মেধা মনন ব্যবহার করে একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোর্স-কারিকুলার উন্নয়ন একাডেমিক কাউন্সিলে বিস্তারিত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যেখানে উপাচার্য মহোদয় সভাপতিত্ব করেন। সে কারণে বলা যায়, কোর্স-কারিকুলার উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রছাত্রীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমসহ মুক্ত চিন্তার সুযোগও উপাচার্য মহোদয়ের উদ্যোগের উপরই অনেকাংশে নির্ভরশীল। কোনো কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট মান সম্মত না হলে বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রাজুয়েট উভয়ই তার গুরুত্ব হারায়। দেশ, জাতি তথা মানব সমাজ যা পাবার কথা তা পায় না, ফলে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়।
উপাচার্য মহোদয় যা করবেন তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করবেন যা কিনা যথাযথ কোর্স-কারিকুলার উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে মান সম্মত গ্রাজুয়েট তৈরি করতে পারবে। তার জন্য উপাচার্য মহোদয়কে চার বছরের একটি সময় দেয়া হয় এবং এ চার বছরে তিনি চাইলে তার নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে পারেন। শিক্ষার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা করে জ্ঞান সৃষ্টি করার নেতৃ্ত্বও উপাচার্য মহোদয় দিবেন এটাও প্রত্যাশিত। সেক্ষেত্রে উপাচার্য মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমনভাবে নির্দেশনা দিবেন যাতে তাঁরা নিজেরা তাঁদের দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে দেশ-বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে গবেষণা পরিচালনা করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারেন। গবেষণার উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সংস্কৃতি অন্যতম সহায়ক নিয়ামক হিসেবে কাজ করে থাকে। একারণে শিক্ষা ও গবেষণা সহায়ক প্রশাসনিক সংস্কৃতির উন্নয়নেও উপাচার্যের ভূমিকা প্রত্যাশা করা হয়। শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ তথা সংস্কৃতি বা ইনস্টিটিউশন বলতে এমন কিছু বুঝায় যা আসলে অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শৃঙ্খলা, শিক্ষকদের মধ্যে শৃঙ্খলা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। দেশের সার্বিক শৃঙ্খলার বিষয়টি যদিও উপাচার্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না তবে সেটির প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে সেটাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার দায়িত্বও উপাচার্যের উপর বর্তায়। উক্ত পরিবেশ বজায় থাকলেই কেবল যথাসময়ে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব হয় এবং সময়মত গবেষণা কার্যক্রম সমাপ্ত করা যায়। তা না হলে মান সম্মত শিক্ষা দিয়ে সময়মত নিয়োগকারীদের প্রত্যাশানুযায়ী গ্রাজুয়েট বের করা সম্ভব হয় না।
দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় এমন একজন উপাচার্য নিয়োগ দিবেন যিনি উল্লেখিত বিষয়সমূহে যোগ্য হবেন এটাই সকলের প্রত্যাশা। একথা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে একজন উপাচার্যকে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ বজায় রাখতে অনেক বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয় এবং সে বিষয়গুলোও আবার বিভিন্নভাবে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পরস্পর সম্পর্কিত। শিক্ষা ও গবেষণা পরিচালনা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ প্রদান, আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয়াবলী পরিচালনা করা, উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা, সরকারের অন্যান্য নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা ইত্যাদিও উপাচার্যের কাজ। উপাচার্য মহোদয় তাঁর প্রজ্ঞা দ্বারা উক্ত কাজগুলো সম্পাদন করবেন এবং অন্যান্য আনুসঙ্গিক বিষয়গুলোর সমন্বয় সাধনে সমর্থ হবেন এটাও প্রত্যাশিত। এগুলোর উপরই একজন উপাচার্যের সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভর করবে। এই সমন্বয় সাধন করার বিষয়টি তাঁর প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব দেবার সামর্থের উপর নির্ভর করে। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত সংস্কৃতিও একটি অন্যতম বিবেচ্য বিষয় যা উপাচার্য মহোদয়কে সবসময় খেয়াল রাখতে হয়। আমাদের মতো দেশে সুষ্ঠুভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সীমাবদ্ধতাও কম নয়। প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জনের জন্য একজন উপাচার্য তাঁর যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। চেষ্টা এইজন্য করবেন যে তাঁর জবাবদিহিতা দেশের আচার্যের নিকট তথা জণসাধারণের নিকট। দিন শেষে জণসাধারণের নিকট যে দায় তা তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। সমাজের নিকট উপাচার্য মহোদয়ের অবস্থান অত্যন্ত সম্মানজনক যার সাথে রাষ্ট্রীয় পদ মর্যাদার তুলনা করা অনেকটাই অর্থহীন। উপাচার্য মহোদয়গণ তাঁদের পদমর্যাদা রক্ষা করবেন এটাও তাঁদের নিকট সমাজের কাংখিত প্রত্যাশা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্বশাসন থাকার প্রধানতম কারণ হচ্ছে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ থাকা তবে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের আইনসিদ্ধ সহায়তাও কাম্য। উপাচার্য নিয়োগের জন্য বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানসমৃদ্ধ, নৈতিকতা ও যোগ্যতা সম্পন্ন সৎ, চরিত্রবান, ব্যক্তিত্ববান অভিজ্ঞ শিক্ষকদের বেছে নেয়া প্রয়োজন। ব্যক্তির রাজনৈতিক সচেতনতাও বিবেচনায় থাকতে পারে তবে তা যেন অন্য সব কিছু ছাপিয়ে না যায়। মনে রাখা দরকার যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে দেশের পরিকল্পনা কমিশনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাজনৈতিকভাবে সচেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের পথিতযশা শিক্ষক, বিজ্ঞানী ও সর্বজন স্বীকৃত জানী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করেছিলেন বলেই সকল ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন বা ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব হয়েছিল।
পরিশেষে শিক্ষা পরিবারের একজন হিসেবে সদাশয় সরকারের নিকট প্রত্যাশা রাখবো যেন ভবিষ্যৎ শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য স্কুল, কলেজ, ডিগ্রি প্রদানকারী ইনস্টিটিউট এর প্রধান নিয়োগদানে আরো যত্নশীল হন এবং বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে আরো স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়া অবলম্বনের মাধ্যমে সমাজের কাংখিত শিক্ষানুরাগীকে বেছে নেন।
লেখক: অধ্যাপক , কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।