The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪

তাপদাহ প্রশমনে বৃক্ষ রোপণের বিকল্প নেই

কাজী বনফুল: তীব্র তাপদাহে পুড়ছে দেশ। সকলে বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছে। যে যার মত প্রার্থনায় নিমজ্জিত বৃষ্টি ও শীতলতার। আমরা আমাদের নিজেদের গলায় ইচ্ছাকৃত ভাবে যে ফাঁস লাগিয়েছি সে ফাঁস আমাদের নিশ্বাসকেই চেপে ধরেছে কঠিক অবরুদ্ধতায়। আমরা এখন নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই আটক হয়ে কান্নাকাটি করছি মাঠে ময়দানে। অথচ কত বড় বড় বৃক্ষ ছিলো আমাদের, সবুজের সমারোহে সমৃদ্ধ ছিলাম আমরা। সে সকল প্রাণবন্ধু গাছগুলোকে কেটে আমরা উজাড় করেছি নিষ্ঠুর রসিকতায়।

যখন কোন অঞ্চলে তাপকে নিয়ন্ত্রণ করার মত শক্তি কমে যায় ঠিক তখনই সে অঞ্চলে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে । বৃক্ষ হচ্ছে তাপকে প্রশমিত করার সেই আদি অস্ত্র যা আমরা ধীরে ধীরে হারাতে বসেছি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষ বন-বৃক্ষ উজাড় করে ফেলছে। গত ২০ বছরে যে পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছে তার অর্ধেকও নতুন করে রোপন করা হয়নি। আর যা রোপন করা হয়েছে সেটা বড় হতে হতে আরো অনেক বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হবে। এই যে বৃক্ষের শূন্যতার সার্কেল এটা পূরণ করতে আমাদের বহু সময় কেটে যাবে বা অসম্ভব প্রায়। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গাছ কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন নতুন ঘর-বাড়ি এবং আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি ইট- ভাটা উত্তপ্ত চুল্লীর ভেতর।

অথচ খুব বেশি আগের কথা নয় গ্রীষ্মের এমনই কোন উত্তপ্ত দিনে দাদার সাথে পিয়াজখালি হাটে যেতাম। আমাদের অঞ্চলে পিয়াজখালি হাট ছিলো সবচেয়ে বড় হাট। হাট শেষে যখন বাড়ির পথে ফিরতাম তখন দেখতাম অনেক হাটুরে বড় বড় গাছের নিচে তাদের পথ চলার ক্লান্তি দূর করার জন্য বিশ্রাম নিচ্ছে। আমরাও সেখানে বসে জিড়িয়ে নিতাম। বড় বড় গাছগুলোকে ভেদ করে সূর্যের তাপিত রশ্মি মাটিকে স্পর্শ করতে পারতো না, শীতলতার এক অদৃশ্য চাদরে আচ্ছাদিত থাকতো চারপাশ। সে সময় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভেতর থাকতো। গাছগুলো দেখে মনে হতো যেন নিজের মায়ের মত আঁচল বিছিয়ে সন্তানদের ক্লান্তি দূর করছে। কি দারুণ ও চমৎকার দৃশ্য ছিল, সকলে এক সাথে বসে দীর্ঘ পথের ক্লান্ত হৃদয়কে গল্পে গল্পে শান্ত ও শীতল করে বাড়ির পথে যাত্রা করতো। তখন যে বড় বড় গাছ দেখতাম সে সকল গাছ এখন আর নেই, গাছগুলোর কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি গাছগুলোকে হত্যা করা হয়েছে, নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে সে সকল গাছ কেটে। তখন দূর থেকে গাছগুলো দেখলে মনে হতো সবুজের উঁচুনিচু পাহাড়ের ঢেউ অথচ এখন দূর থেকে সে সকল জায়গা দেখলে মনে হয় কংক্রিটের প্রাচীর আর টিনের চকচকে বাসনের থালা যেন সূর্যের তাপে জ্বলজ্বল করছে। গাছগুলোকে হত্যা করে গড়ে উঠেছে এ সকল বাড়িঘর।

আমাদের একান্নবর্তী পরিবারগুলো যখন স্বার্থ এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করলো ঠিক তখন থেকেই আমরা গাছগুলোকে উপড়ে ফেলে গড়তে লাগলাম নতুন নতুন ঘর। আমরা এক দিকে যেমন একা হতে লাগলাম তেমনি একই ভাবে আমাদের চারপাশের গাছগুলোর পরিমাণও কমতে লাগলো। এ এক জন্মজন্মান্তরের সম্পর্কের বিচ্ছেদ। আমরা যেন নিজেরাই নিজেদের বিপদকে বরণ করেছি প্রচন্ড আগ্রহ সমেত। বৃক্ষহীন পৃথিবী আর নরকের মাঝে খুব বেশি তফাৎ থাকার কথা নয়।

এই হলো আমার তৎকালীন ও বর্তমান গ্রামের অবস্থা এবার আসি শহরের গল্পে। ছোট বেলা থেকেই একটা প্রবাদ অনেক বার শুনেছি সেই চিরচেনা প্রবাদটি এখানে বেশ কার্যকর বটে। ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বলেছিলেন—নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়? আসলেই এড়ায় না আমরা আজ পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি গাছগুলোর নিভৃত অভিশাপের প্রায়শ্চিত্তে। এমন স্নিগ্ধ বন্ধুত্বের আশ্রয়কে নিজেরাই গলা টিপে হত্যা করে এখন গরমের প্রচন্ড তাপদাহে চিৎকার করি একটু শীতল পরশের আশায়।

আমার গ্রামের যদি এমন করুন অবস্থা হয় তাহলে শহরের অবস্থা তো আরো বেশি ভয়ানক। গ্রাম যদি এভাবে বৃক্ষ শূন্য হতে থাকে তাহলে তার প্রভাব শহরে পড়বে না এটা তো হতে পারে না, সে প্রভাব আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। চারপাশে শুধু কংক্রিটের প্রাণহীন আবদ্ধ খাঁচা, সে খাঁচায় তীব্র তাপদহনে ছটফট করছে কোটি কোটি মানুষের ঝাঁক। কোথাও তেমন সবুজের রংতুলির আঁচড় নেই কেবলই চারপাশে ইট-পাথরের ঝকঝকে মৃত্যুর আস্বাদন। যেখানে সবুজ নেই সেখানে মমতা, প্রণয়, স্নেহ, মানবিকতা থাকবে সেটা আমি কোন ভাবেই বিশ্বাস করি না। তাই হয়তো এ শহর এত বেশি রুক্ষ, শুষ্ক, মরুভূমির মত দয়াহীন, মমতাহীন শূন্যতার সাগর। চারপাশে এত এত মানুষের ঝাঁক অথচ কেউ কারো নয় কেউ কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলে না কেউ কাউকে ভালোবাসে না। মানুষ হয়ে উঠেছে মানুষের ভয়ের কারণ। কেউ কারো সাথে উপর্যুপরি কথা বললে অপরজন ভাবে নিশ্চিত কোন খারাপ মতলব আছে। অথচ এমন পৃথিবী কী আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা কোথায় রেখে যাবো কাদের কাছে রেখে যাবো। এমন শুষ্ক, মমতাহীন মরুভূমির প্রান্তরে।

বন্ধুদের মধ্যে গাছ আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু অথচ গাছগুলোকে আমরা কি অবলীলায় কেঁটে ফেলছি। একটি বৃক্ষ কেঁটে ফেলা যতটা সহজ তা রোপণ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা একটা আস্ত মানুষের জীবনের আয়ুকে অতিক্রম করেও সম্ভব হয়না। আমাদের অঞ্চলে এমন কিছু গাছ আছে যাদের বয়স দেড়শো থেকে দুইশো বছর। সে গাছগুলোকে কাঁটার জন্য অনেক ভাবে বৃক্ষ রাক্ষসরা চেষ্টা করেছে কিন্তু গাছকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া কিছু মিথ, কিছু গল্প গাছগুলোকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। এই বৃক্ষ রাক্ষসরা চেষ্টা কখনোই ছাড়বে না নানান কৌশল অবলম্বন করে তারা গাছগুলোকে ভক্ষণ করতে মরিয়া হয়ে আছে এবং হয়তো ভক্ষণ করেও ফেলবে।

আমরা যদি এখনো গাছের ব্যাপারে সচেতন না হই তাহলে সাহারা মরুভূমির উত্তপ্তের তীব্র আচঁ আমাদের গায়ে লাগতে খুব বেশি সময় লাগবে না যা ইতিমধ্যে কিছুটা হলেও আমরা অনুভব করছি। আমাদের এই অস্তিত্ব সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে হতে আমরা ছাইয়ের স্তূপে পরিনত হয়ে যাবো হয়তো খুব দ্রুতই। যার জন্য আমাদের যথার্থ পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করার সর্বোত্তম সময়। তা না হলে আমাদের এই অপসিদ্ধান্তের খেসারত হিসেবে ভয়ানক পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

পৃথিবীর সকল অঞ্চলে নতুন নতুন সিস্টেম চালু করে বৃক্ষ রোপন সহ সবুজায়নের দিকে বিশেষ মনযোগ দেওয়া হচ্ছে আর আমরা আমাদের যে গাছ নামক সবচেয়ে উপকারী বন্ধুটি রয়েছি তাকে নিধন করকে সর্বদা ব্যস্ত। আমাদের এই অপরাধের শাস্তিই হচ্ছে এই তীব্র তাপদাহ ও এই উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধি। এখন তাপমাত্রা ৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস আমরা যদি এখনো সচেতন না হই তাহলে এই তাপমাত্রা আগামী ১০ বছরে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না। যেটা অনেক বেশি সংকটময় মুহূর্ত হবে আমাদের জন্য যা ভাবতেই শিহরিত হতে হয়।

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে গাছ আছে বলেই আমরা আছি, যেদিন তারা আমাদের মাঝ থেকে নিশ্চিহ্ন হবে সেদিন আমরাও বিলুপ্ত হয়ে যাবো এই পৃথিবী থেকে। আমাদের টিকে থাকাটা সম্পূর্ণ ভাবেই তাদের টিকে থাকার উপর নির্ভর করছে।

গাছগুলো আজ বড্ড অভিমানে মুখ ফিরিয়েছে আমাদের থেকে, অনেক বেশি অপ্রয়োজনীয় নির্যাতন করেছি তাদের উপর। তাদের সেই কষ্টের অশ্রু আজ তীব্র দাবদাহের ন্যায় ঝরে পড়ছে পৃথিবীর বুকে। অতিদ্রুত যদি তাদের এই ক্ষতের এবং কষ্টের দাগ মুছে দিতে না পারি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খুব দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই পৃথিবী থেকে। একমাত্র গাছই পারে আমাদের এই ভবিষ্যৎ সংকট থেকে আমাদের রক্ষা করতে। যত বেশি গাছ রোপন করা হবে তত বেশি শীতলতায় পরিপূর্ণ হবে আমাদের জীবন।

তাদের এই ক্ষত ও কষ্ট দূর করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বেশি বেশি গাছ রোপন করা। এই উচ্চ তাপমাত্রা কে রুখে দেওয়ার জন্য আমাদের সকলের প্রচুর পরিমাণে গাছ রোপন করতে হবে। গাছ রোপন ছাড়া আমাদের টিকে থাকার কোন বিকল্প নাই। একটা মানুষের অক্সিজেনের প্রতিদানের বিপরীতে কমপক্ষে ৫০- ১০০ টি করে গাছ লাগানো উচিৎ।
এই গাছই হচ্ছে আমাদের পৃথিবীর প্রথম ফুসফুস ও আমাদের ফুসফুসের জ্বালানি। তাই আসুন আমরা গাছ কাটা থেখে বিরত থাকি এবং যেখানে যতটুকু ফাঁকা জায়গা আছে সেখানে বৃক্ষ রোপন করি। সবুজ ও মানুষ একে অপরের প্রতিপক্ষ না হয়ে, হয়ে উঠুক একে- অপরের প্রাণের বন্ধু, প্রাণের স্বজন।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.