ইবি প্রতিনিধি : ১৯৮৭ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য শিক্ষার্থীরা উপাচার্য বরাবর আবেদন করলে তিনি ঘোষণা দেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ ও ফুল দেওয়ার নামে কোনো অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড বরদাস্ত করা হবে না। শহীদ মিনার নির্মাণের নামে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে মূর্তি পূজা করবে তাদের হতে হবে বহিষ্কার। উপাচার্যের এ ঘোষণাকে উপেক্ষা করে ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার নির্মাণে নেতৃত্ব প্রদানকারী প্রায় ২০ শিক্ষার্থীদের হতে হয়েছিল বহিষ্কার এবং শিক্ষাবর্ষ প্রমোশন বাতিল। মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর করা হয়েছিলো হয়রানি।
তবে এসব ভয়ভীতি কখনোই টলাতে পারেনি তৎকালীন অই ছাত্রনেতাদের। দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীরা ছিলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ৫২’র ভাষাসৈনিকদের স্মৃতি ও মর্যাদা রক্ষায় সেইসব শিক্ষার্থীরা বহিষ্কার হতেও পিছপা হয়নি। সকল বিপত্তি উপেক্ষা করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ মিনার। সাথে সাথেই প্রশাসন ৪ জনকে বহিষ্কার করেন। বহিষ্কারের এই ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে বহিষ্কারাদেশ উঠিয়ে নিলেও প্রায় ২০ শিক্ষার্থীর প্রমোশন অফ হয়ে যায়।
এসব ঘটনার কিছু বছর পর ক্যাম্পাস স্থানান্তর করে কুষ্টিয়ার শান্তিডাঙ্গায় আনা হয়। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থানান্তরের পরের বছরেই ১৯৯১ সালে স্থাপন করা হয় ক্যাম্পাসের প্রথম শহীদ মিনার। যা ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। তবে শিক্ষার্থীদের শত আবেগ ও ত্যাগের ফসল যে শহীদ মিনারটি এখন অযত্নে ও অবহেলায় ভরে আছে আগাছা ও আবর্জনায়। পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগারে।
প্রথম শহীদ মিনার স্থাপনের প্রায় ২০ বছর পর ২০১১ সালে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। সে থেকেই নতুন শহীদ মিনারে ব্যাপক পরিসরে নিয়মিত মাতৃভাষা দিবস উদযাপন হয়ে আসছে। তারপর থেকে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে অযত্নে পড়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ মিনারটি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র-নজরুল কলা অনুষদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে শহীদ মিনারটির অবস্থান। অনেকদিন ধরে ভবনটির কাজ চলতে থাকায় ভবনটির কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম সমূহ শহীদ মিনারটির আশপাশে পড়ে আছে। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় মিনারটির চারিদিকেও ভরে গেছে ময়লা-আবর্জনা ও আগাছা।
এ বিষয়ে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র এবং বর্তমান ফাইন আর্টস বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. এ. এইচ.এম আক্তারুল ইসলাম। তার স্মৃতিচারণে ফুঁটে উঠেছে সেইসময়ের স্মৃতি। স্বাধীন বাংলাদেশের এই ভূখন্ডে ভাষা শহীদদের স্মরণে আমরা যারা ফুল দিতে যেতাম তখন ক্যাম্পাসের শিবিরের সদস্যরা ‘আজকের এই দিনে গোলাম তোমায় মনে পড়ে ‘ এরকম স্লোগানে কুখ্যাত রাজাকারদের নাম মুখে নিয়ে আমাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করতো। তখনকার চিত্র দেখে আমরা যারা সচেতন ও প্রগতিশীল মানুষ ছিলাম আমরা সবাই বিস্মিত হতাম। ফুল দিতে গেলেই আশপাশে গুলির শব্দ হতো, ককটেলের শব্দ হতো। এরপরও জীবনের শঙ্কা নিয়ে আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে এটি আমাদের ত্যাগ তিতিক্ষার বহনকারী। এর সংস্কার করে স্মৃতিবিজড়িত হিসেবে রাখা উচিত।
শহীদ মিনার নির্মাণ করতে গিয়ে বহিষ্কারকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোঃ শাহজাহান আলম সাজু। তিনি বলেন, উপাচার্যের বাধা উপেক্ষা করেই আমরা বাঁশ, রড ব্যবহার করে তখনকার গাজীপুর ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার তৈরি করেছিলাম। এরজন্য আমাদের অনেকেই বহিষ্কারও হতে হয়েছিলো। আমাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক ড. সিরাজুল স্যার এই শহীদ মিনারের ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। এখন যদি শহীদ মিনারের পবিত্রতা না থাকে এটা খুবই দুঃখজনক। এত আন্দোলনের পরে পাওয়া শহিদ মিনার যদি আজকে এভাবে অযত্নে অবহেলায় থাকে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু নেই।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিস প্রধান ও উপ-রেজিস্ট্রার মোঃ সামছুল ইসলাম জোহা বলেন, আমরা তৎকালীন সময়ে নানা বাধা উপেক্ষা করে শহীদ মিনারে ফুল দিতাম। নতুন শহীদ মিনার স্থাপিত হওয়ায় এই শহীদ মিনারটি দৃষ্টির আড়ালে পড়ে যায়। ফলে পরবর্তীতে আর সংস্কার কাজ করা হয়নি। যেহেতু এটি এখন নজরে এসেছে এ বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় উপাচার্য স্যারের সাথে কথা বলব। এদিকে এস্টেট অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রথম শহীদ মিনারটি স্থানান্তর করে বর্তমান শহীদ মিনারের পাশে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, মাতৃভাষা দিবস এবং শহীদ মিনার আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান জুড়ে রয়েছে। প্রথম শহীদ মিনারটি এখন কি অবস্থায় আছে এবং এ সম্পর্কে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তা আমি খতিয়ে দেখবো।