সাইবার সিকিউরিটি বা সাইবার নিরাপত্তা বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত বিষয়। বেশ কয়েকদিন আগে দেশের সাধারণ নাগরীকদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজ নিরাপত্তা ক্রটির করনে উন্মক্ত হয়ে পড়ে। যা নিয়ে দেশে ও দেশের বাহিরে তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়। প্রশ্ন ওঠে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাইবার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাইবার সিকিউরিটির বিষয়ে আলোচনা হওয়া আবশ্যক।
সাইবার সিকিউরিটি যা কম্পিউটার সিকিউরিটি বা আইটি সিকিউরিটি নামেও বেশ পরিচিত। সাইবার সিকিউরিটি বলতে মূলত কম্পিউটার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক, ডিভাইস এবং ডেটাতে অননুমোদিত অ্যাক্সেস, ক্ষতি সাধন, চুরি, ব্যাঘাত বা অন্যান্য সাইবার হুমকি থেকে রক্ষা করাকে বুঝিয়ে থাকে। সাইবার সিকিউরিটি মূলত ডিজিটাল সম্পদের সুরক্ষা এবং গোপনীয়তা, অখণ্ডতা এবং তথ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পিত একটি কার্যপ্রনালী।
সাইবার নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য হল অননুমোদিত ব্যক্তি বা সংস্থাগুলিকে সংবেদনশীল ডেটা বা সিস্টেমগুলিতে অ্যাক্সেস লাভ থেকে বিরত রাখা এবং সম্ভব্য কোনও ক্ষতিকারক কার্মকান্ড ঘটতে পারে তা সনাক্ত করা এবং সেই অনপাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের চলার পথে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। সেই প্রযুক্তিগত সুবিধার সাথে সাথে সাইবার হুমকির এবং সাইবার জটিলতা মোকাবেলায় সাইবার নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাইবার সিকিউরিটির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব:
১. তথ্যের সুরক্ষা: সাইবার সিকিউরিটি সংবেদনশীল তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। যেমন ব্যক্তিগত তথ্য, আর্থিক রেকর্ড এবং মেধা সম্পত্তি, গোপনীয় তথ্য ভান্ডারের সুরক্ষিত রাখতে সাইবার সিকিউরিটি ভূমিকা পালন করে।
২. বিশ্বাস এবং খ্যাতি ধরে রাখা: শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রাহকদের এবং স্টেকহোল্ডারদের ডেটা এবং গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে তাদের সাথে বিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
৩. আর্থিক ক্ষতি রোধ করা: সাইবার আক্রমণের ফলে সংস্থাগুলির জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতি হতে পারে, যার মধ্যে ডেটা চুরি, মুক্তিপণের অর্থ প্রদান এবং ডাউনটাইম এর সাথে সম্পর্কিত খরচ কমাতে সাইবার সিকিউরিটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
৪. জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে: সরকার এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো খাতগুলি সাইবার হুমকির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য মূলত সাইবার নিরাপত্তার উপর নির্ভর করে। সাইবার সিকিউরিটির তারতম্য বা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্যার অভাবে গুরুতর জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
৫. সাইবার ক্রাইম থেকে সুরক্ষা: যথাযথ সাইবার সিকিউরিটি গুরুতর সাইবার অপরাধীদের আটকাতে সাহায্য করে। সাইবারে যথাযথ নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে পারলে ক্রিমিনাল কার্যকলাপ থেকে নিরাপত্তা পাওয়া যায়।
সাইবার সিকিউরিটির মূল উপাদান:
সাইবার সিকিউরিটি বেশ কতগুলো মূল উপাদান নিয়ে গঠিত যা কম্পিউটার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক, ডিভাইস এবং ডেটাকে সাইবার হুমকি থেকে রক্ষা করতে একত্রে কাজ করে। একটি শক্তিশালী এবং বিস্তৃত সাইবার নিরাপত্তা কৌশল তৈরি করার জন্য এই উপাদানগুলি অপরিহার্য। এখানে সাইবার নিরাপত্তার প্রধান উপাদান উল্লেখ করা হলো:
১. নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা: সাইবার স্পেসে রক্ষিত ডেটার অখণ্ডতা এবং গোপনীয়তা রক্ষা করা জড়িত । নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ফায়ারওয়াল, অবৈধ অনুপ্রবেশ সনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কের (ভিপিএন) নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
২. তথ্যের নিরাপত্তা: তথ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অননুমোদিত অ্যাক্সেস, পরিবর্তন, বা মুছে ফেলা থেকে সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রক্ষা করাই হলো তথ্যের নিরাপত্তা। সাইবারে রক্ষিত তথ্যের নিরাপত্তার জন্য এনক্রিপশন, অ্যাক্সেস কন্ট্রোল, নিরাপদ যোগাযোগ প্রোটোকল মূল্যবান তথ্য রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়।
৩. অ্যাপ্লিকেশন নিরাপত্তা: অ্যাপ্লিকেশন নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যে সফ্টওয়্যার এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে কোন দুর্বালতা বা ভারনাবিলিটি নেই। যে দুর্বালতার ফাক দিয়ে হ্যাকার বা আক্রমণকারীরা কোন ধরনের ক্ষতি করতে পারে। ডেভলপারগণ নিরাপদ ও কার্যকরি কোডিং ব্যবহার করে সম্ভাব্য ত্রুটিগুলি সনাক্ত এবং সংশোধন করতে নিয়মিত অডিট এবং পরীক্ষা পরিচালনা করে থাকেন।
৪. এন্ডপয়েন্ট সিকিউরিটি: সাইবার সিকিউরিটির ক্ষেত্রে এই উপাদানটির লক্ষ্য হল- প্রথক পৃথক ডিভাইস, যেমন কম্পিউটার এবং স্মার্টফোনকে ম্যালওয়ার বা ভাইরাস সহ অন্যান্য সাইবার হুমকি থেকে রক্ষা করা। অ্যান্টিভাইরাস সফ্টওয়্যার, এন্ডপয়েন্ট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স (EDR) টুলস এবং মোবাইল ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট (MDM) সাধারণত এন্ডপয়েন্ট সিকিউরিটির জন্য ব্যবহৃত হয়।
৫. ক্লাউড সিকিউরিটি: ক্লাউড কম্পিউটিং যত বেশি প্রশারিত হচ্ছে, ক্লাউড সিকিউরিটির বিষয়টিও ততটাই গুরুত্ব পাচ্ছে। ক্লাউডে সংরক্ষিত ডেটা সুরক্ষিত রাখা, ক্লাউড-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনগুলিকে সুরক্ষিত রাখা এবং সঠিক অ্যাক্সেস নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে ক্লাউড সিকিউরিটি কাজ করে থাকে।
৬. আইডেন্টিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস ম্যানেজমেন্ট (আইএএম): আইএএম ব্যবহারকারীর পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে সাইবারে অ্যাক্সেস পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণের কাজ করে থাকে। এটি সাধারণত পরিচয় যাচাইকররণ, অনুমোদনের মত পদ্ধতিগুলি নিশ্চিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। আইএএম শুধুমাত্র অনুমোদিত ব্যবহারকারীকে নির্দিষ্ট ডেটা বা সাইবারে অ্যাক্সেস প্রদান করে।
৭. ঘটনার প্রতিক্রিয়া এবং ব্যবস্থাপনা: সাইবার নিরাপত্তা শত ভাগ নিশ্চিত করা খুবই দুরহ ব্যপার। তাই অনিবার্যভাবে, কিছু সাইবার আক্রমণ সংঘটিত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সেক্ষেত্রে ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নিরাপত্তার ঘারটিগুলো অবিলম্বে সনাক্ত করা এবং সমাধান করা, ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সহ কম্পিউটার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক, ডিভাইসকে অতিদ্রু তার পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।এবং স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে ফিরে আসা জড়িত।
সাইবার সিকিউরিটি হচ্ছে ক্রমাগত বিকশিত হুমকির বিরুদ্ধে একটি চলমান যুদ্ধ এবং এর জন্য সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ের সর্বচ্চ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, সর্বোত্তম অনুশীলন এবং দক্ষ পেশাদারদের নিয়োগ এবং উন্নত নিরাপত্তা বলয় তৈরি একটি নিরাপদ ডিজিটাল সমাজ তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ।