বিকেল বাজে তখন ৪টা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের পাশে ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন একজন। তার নাম আব্বাস উদ্দিন। প্রথমে দেখে সৌখিন দোকানী মনে হবে নিশ্চিত। তবে আব্বাসের ঝালমুড়ি বিক্রেতা হয়ে ওঠার গল্পটি সংগ্রামের, কষ্টের। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। আব্বাস ছোটবেলা থেকেই আর্থিক টানাপোড়ন দেখে বড় হয়েছে। মেধাবী আব্বাসের প্রধান প্রতিবন্ধকতা দারিদ্র্য। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নন তিনি।
ছোটবেলা থেকে মেধাবী আব্বাস বড় স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠছিলেন। কিন্তু শুরু থেকে আর্থিক অনটন, বাবা-মায়ের টানাপোড়নের সংসার বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার স্বপ্নপূরনে।পড়ালেখায় তার অদম্য আগ্রহ দেখে তার পাশে দাঁড়ায় বড় ভাই আক্কাস উদ্দিন। কিন্তু করোনা কালীন সময়ে বড় ভাইয়ের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ফের দুঃখ নেমে আসে তার ও তার পরিবারে। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট আব্বাস। ভাই আক্কাস ও বোন ফাতেমার বিয়ে হয়ে গেলে মা শাহানারা বেগমকে নিয়ে দুজনের সংসার তাদের।
নবম শ্রেণিতে পড়াকালে চাকরি করে নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়ান তিনি। দর্জি, রাজমিস্ত্রির সহকারী, ভিডিও ফটোগ্রাফিসহ নানা কাজ করতে হয়েছে তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ছোট্ট একটি বাসায় মাকে নিয়ে বসবাস করেন আব্বাস। সম্প্রতি সংসারের টানাপোড়ন নিয়ে চিন্তার ভাজ পড়ে আব্বাসের কপালে। তখনি মাথায় আসে ক্যাম্পাসের সামনে ঝালমুড়ি বিক্রির আইডিয়া। পড়ালেখার পাশাপাশি এই ঝালমুড়ি বিক্রি করে সংসার চালাতে হচ্ছে বলে জানান আব্বাস। তিনি বলেন, ক্লাস শেষ হওয়ার পর যতটুকু সময় পাই সেই সময়টাতে বিক্রি করি। বেচাকেনা শেষ করে বাসায় যেতে প্রায় রাত ১০টা বেজে যায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে সহজে ঘুম চলে আসে তবে রাত ৪টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করার চেষ্টা করি।
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা যথাক্রমে ৪.১৭ ও ৩.৬৭ রেজাল্ট করা আব্বাসের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার স্বপ্ন ছিল স্কুল জীবন থেকে। অর্থের অভাবে ভর্তির কোচিং করার পর্যন্ত সুযোগ পায়নি আব্বাস। বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে বই পড়েছেন। তার এই বন্ধর পথ চলায় সবসময় সাহস জুগিয়েছে খালাতো বোন জান্নাত। এইচএসসিতে প্রথমবার ইংরেজিতে কৃতকার্য হতে না পারা আব্বাস ভর্তি পরীক্ষায় সেই ইংরেজিতে ৩০ মার্কের মধ্য ২৫ পেয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়। আর্থিক অনটনের কারণে কয়েকটি মেধাবৃত্তি পেলেও শর্ত সাপেক্ষ হওয়ায় নিতে পারেনি বলে জানান।
আব্বাসের সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রস্তুতির পাশাপাশি বিদেশে পড়ালেখা করতে যাওয়ার বাসনাও আছে। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে পড়লে বিসিএসের পাশাপাশি বিদেশে উচ্চতর শিক্ষার জন্য প্রায় ১৬টি ডিগ্রির সুযোগ রয়েছে। ফুল স্কলারশিপ অথবা ৫০ শতাংশ স্কলারশিপের সুযোগ পেলে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য বিদেশে চলে যাব। তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। নিজস্ব সম্পত্তি না থাকায় এখন থেকেই কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া পরিবারের আয় করার মতো মানুষও নেই। আমি কার ওপর নির্ভর করব? জন্ম থেকেই পরিবারের যতটুকু সামর্থ্য ছিল ততটুকু দিয়ে বড় করেছেন। এখনও পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকাটা নিজের কাছে বোঝা মনে হচ্ছে।
তার মা শাহানার বেগম ছেলের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতেই তিনি ঝালমুড়ির দোকান দিয়েছেন।
আব্বাস বলেন, ক্যাম্পাসের ভিতরে হলে আরো নিরাপদ ও সুবিধা হতো বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট বসার মতো কোথাও জায়গা পাচ্ছি না, যার কারণে যখন যেখানে সুযোগ পাই সেখানে বসে দোকান চালিয়ে নিই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে ব্যবসার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নিতে সহজ হতো।
আব্বাসের ঝালমুড়ি খেতে বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি ভিড় লেগে থাকে শিক্ষার্থীদের। তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এভাবে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে পারে সেটাই কল্পনাতীত। তার জীবন সংগ্রামের, তার অদম্য সাহস আমাদের মুগ্ধ করে। তার ঝালমুড়ি কেমন হচ্ছে সেটি বিষয় নয়, সে আমাদের ক্যাম্পাসের। আমরা এজন্য এখানে খেতে আসি। এসময় অনেকে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে আব্বাস বসতে দেয়ার দাবি জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহ. আমিনুল ইসলাম আকন্দ বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা পূর্ব থেকে অবগত আছি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আমরা সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি, তার নাম আমাদের নোটবুকে আছে। এছাড়াও ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করতে চাই। সুনির্দিষ্ট স্থানে আব্বাসের দোকানের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের রিসোর্স সীমিত থাকার কারণে আমরা কোনো কিছু করতে পারছি না। বিষয়টা সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে। এ বিষয় নিয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।