‘আমি আমার জীবনের বিনিময়ে বলছি, আমি চুরি করি নাই’ লিখে গৃহবধূর আত্মহত্যা
ভোলার লালমোহনে মৃত্যুর আগে ১৩ পৃষ্ঠার ডায়েরি লিখে বিষপানে পান করে জান্নাতুল ফেরদৌস রত্না (২৫) নামে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন। চুরির অপবাদ সইতে না পেরেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ডায়েরিতে উল্লেখ করেন। এতে অভিযুক্ত করে গেছেন শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে।
গতকাল বুধবার বিকেলে ওই গৃহবধূর ডায়েরি খুজে পান তাঁর স্বামী লিটন। পাওয়ার পর তিনি শ্বশুরকে খবর দেন। পরে তাঁরা বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করেন।
এর আগে গত রোববার (৩০ অক্টোবর) রাতে ভোলার লালমোহনের চরভূতা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মাহাবুব চৌকিদার বাড়িতে বিষপানে আত্ম’হত্যা করেন ওই গৃহবধূ। গৃহবধূ রত্না মো. লিটনের স্ত্রী এবং দুই সন্তানের জননী।
বুধবার পাওয়া ওই ডায়েরিতে গৃহবধূ লিখেছেন, ‘আমার জন্য দো’য়া করবেন আমি যাতে পর’পারে ভালো থাকতে পারি। সবার মতো আমিও সুন্দর একটা জীবন নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই সমাজ আমাকে বেঁচে থাকতে দিল না। মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে সমাজে মুখ দেখাতে ইচ্ছে করেনা। বাবা-মা স্বামীর সম্মানের দিকে তাকিয়ে কখনো কোনো পরপুরুষের সাথেও কথা বলি নাই, নিজের চরিত্রকে খারাপ করি নাই। কিন্তু আজ আমি চুরি না করেও চোর সবার মুখে-মুখে।’
ওই ডায়েরিতে গৃহবধূ আরও লিখেছেন, ‘বাবা আমার অনুরোধ আমার স্বামীকে বাদে বাকি কেউরে ছাড় দিবা না, ওরা সবাই মিথ্যেবাদি। আমার চাচা- শশুর ওরা সবাই নাটের গুরু। ওরা সবাই আমার নামে মিথ্যে অপবাদ রটাইছে। আমি কতটা বিশ্বাসী আর সৎ ছিলাম সেটা আমার আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। একটা মানুষের জীবন ছাড়া প্রিয় আর কি হতে পারে!! আমি আমার জীবনের বিনিময়ে বলছি আমি চুরি করি নাই। এখন তোরা খুশি; সবাই খুশিই থাক। আমি চলে গেলাম কেউ আর তোদের সাথে সত্যে’র প্রতিবাদ করবে না। আর বেশি কিছু লিখলাম না। অনেক কথা বলার ছিলো সমাজকে, এই সমাজে ভালো মানুষের কোন মূল্য নাই। সবার কাছে একটা অনুরোধ রইল আমার মেয়ে দু’জনকে দেখিয়েন। ওদের জন্য আমার কতটা কষ্ট হয় বলে বুঝাতে পারবো না। মা ছাড়া কতটা অবহেলিত সন্তান সেটা যার মা নাই সে বুঝে। বাবা-মা পারলে ওদের খেয়াল নিও, না পারলে জোর নাই।’
এভাবেই ডায়েরির ১৩টি পাতায় আরও অনেক লেখা লিখে গেছেন রত্না। স্বামীর উদ্দেশ্যে লিখেছেন, বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, দুই মেয়ের উদ্দেশ্যে লিখেছেন। নিজের দাফন কোথায় করবে সেটাও লিখেছেন। ডায়েরিটি রত্নার স্বামী লিটনই ঘর থেকে উদ্ধার করেন। তবে ডায়েরিতে ৮টি পাতা ছেঁড়া পাওয়া গেছে।
এ ঘটনায় গৃহবধূর বাবা আবুল কাশেম জানান, তাঁর মেয়ে স্বামীর বাড়িতে সুখেই ছিলেন। জামাতা লিটন তাঁর আপন ভাগনে হয়। রত্নার চাচা শশুরের স্থানীয় নাম মো. হাফিজুর রহমান। ভারতে তিনি বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়ে সন্তোষ দে নামে বসবাস শুরু করেন। কিছুদিন আগে তিনি পরিবার নিয়ে ভারত থেকে লালমোহনের ওই বাড়িতে বেড়াতে আসেন। এরপর তার ঘর থেকে একটি স্বর্ণের চেইন ও মোবাইল ফোন চুরি হয়। এতে করে রত্নার বিরুদ্ধেই চুরির অপবাদ দেন চাচাশ্বশুর হাফিজ উদ্দিন ওরফে সন্তোষ দে।
রত্নার বাবা আবুল কাশেম অভিযোগ করেন, তাঁর মেয়েকে চুরির অপবাদ দিয়ে মানসিকভাবে অত্যাচার করে তাঁর চাচাশ্বশুর ও বাড়ির অন্যান্য স্বজনেরা। অপমান আর লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে রত্না ঘরে থাকা কীটনাশক পান করেন।
এদিকে স্ত্রীকে যারা অপবাদ দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন সেই চাচাদের বিচার চান স্বামী লিটনও। তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমার চাচারা অনেক গালিগালাজ করেছে। তাঁকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে।’
ডায়েরির বিষয়ে গৃহবধূর ভাই রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘ডায়েরিটা আমার বাবার মাধ্যমে থানায় পাঠিয়েছি।’
এ নিয়ে জানতে চাইলে ঘটনার উপপরিদর্শক (তদন্ত) সেলিম রানা বলেন, ‘গৃহবধূর বাবার কাছে ডায়েরি আছে সেটি আমাদের জানানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসলে মামলার তদন্তের স্বার্থে সেগুলো নেওয়া হবে।’
লালমোহন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। রত্নার মরদেহ ময়নাতদন্ত করে আনা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। এ ঘটনায় থানায় অপমৃত্যুর একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
আরো পড়ুনঃ বাবা দিনমজুর, ছেলে ২ কোটির স্কলারশিপ পেয়ে পাড়ি দিচ্ছে আমেরিকা