হেদায়েতুল ইসলাম নাবিদ, কুবি প্রতিনিধি:
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের কমিটির বিলুপ্তি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পড়ে আবাসিক হল বন্ধ ও পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীরা।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্র নির্বাহী সংসদ। পরে গত ১ অক্টোবর বিকেল ৩টার দিকে কুবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজার সমর্থক গ্রুপ বহিরাগত শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে মোটরসাইকেলে ক্যাম্পাসে মহড়া দেয়। এ সময় ফাঁকা গুলির আওয়াজ ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
পরে তাদের প্রতিহত করতে বর্তমান কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের অনুসারীরাও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দিতে থাকে। এ সময় প্রশাসনের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন তারা। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে আতংক সৃষ্টি হয়।
এরপর গত ২ অক্টোবর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আগামী ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত হল বন্ধ ও পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই সঙ্গে আগামী ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ক্লাস বন্ধ রাখারও ঘোষণা দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রশাসন ভালোভাবে ব্যবস্থা না নিয়ে পরীক্ষা স্থগিত করায় মাশুল গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমসের ১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী মো. শাহনেওয়াজ তুহিন বলেন, ‘যারা সুষ্ঠু সুন্দর ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে শিক্ষার্থীদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে, তারা কখনো শিক্ষার্থীদের ভালো চায় না। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে বারবার পরীক্ষা পেছানোর নামের ‘ভাঙা রেডিও’ বাজায়। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই হতাশাজনক। আমরা শিক্ষার্থীবান্ধব প্রশাসন চাই, শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস চাই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তিকে কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীর জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। করোনার দীর্ঘ সময়ে পড়ালেখার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য চার মাসে সেমিস্টার করলেও এখন ক্যাম্পাসের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে কিছুদিন পর পর পরীক্ষা স্থগিত হচ্ছে। এতে আমরা সেশন জট নামের অভিশপ্ত জীবনের ঝুঁকিতে পড়েছি। যা আমাদের স্বপ্ন পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
পদার্থবিজ্ঞানের ১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি সবার জন্য করা বাধ্যতামূলক না ঠিক আছে, তবে মুষ্টিমেয় কয়জন ছাত্রের ভুলের মাশুল কেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা দেবে? ছাত্র রাজনীতির কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় করা, কিন্তু বর্তমানে তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার রাজনীতি করতেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কাকে মনের ব্যথা বলব? যেখানে আমাদের অভিভাবকখ্যাত প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই রাজনীতির প্যাঁচে জিম্মি হয়ে আছে। আজ প্রশাসন থেকে কেন পুরো শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করা হচ্ছে?’
এ বিষয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী, বর্তমানে চার মাসে কোর্স শেষ করার কথা। কিন্তু বর্তমানে ছাত্রদের রাজনৈতিক কোন্দলে একটা পরীক্ষার তারিখ প্রায় দু’মাস পিছিয়ে নেওয়া হলো। পরীক্ষার তারিখ ছিল সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখ। পরে তা অক্টোবরের ১২ তারিখে নেওয়া হলো। এখন তাও পরিবর্তন করা হলো। এই রকম হলে কখনো চার মাসে সেমিস্টার শেষ করা সম্ভব না। সম্ভবত শিক্ষার্থীরা সেশনজটের সম্মুখীন হতে পারে।’
শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শেখ মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরিস্থিতির কারণে তা বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এই অল্প সময়ের জন্য সেশনজটে পড়বে না। সেশনজটে পড়ার অন্য জায়গা আছে। শিক্ষকরা যদি সুশৃঙ্খলভাবে ক্লাস, পরীক্ষা, রেজাল্ট পাবলিশ করি তবে সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা কম।’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. দুলাল নন্দী বলেন, ‘অতীতে এই ধরনের সমস্যা শিক্ষক সমিতি খুব ভালোভাবে হ্যান্ডেল করেছে। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন শিক্ষক সমিতির সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত অবশ্যই শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হবে।’
আমরা করোনার সময়ে ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি কাটিয়ে ওঠার জন্য চার মাসে সেমিস্টার করে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখানে এই ধরনের সিদ্ধান্ত কখনোই কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পরীক্ষা এক সপ্তাহ পেছানো মানে এক মাস পিছিয়ে যাওয়া। এখানে শিক্ষকদের বসে আগের পরীক্ষার সিডিউল ঠিক করে পরীক্ষা নিতে হয়, এতে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা করোনার সময়ে ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি কাটিয়ে ওঠার জন্য চার মাসে সেমিস্টার করে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখানে এই ধরনের সিদ্ধান্ত কখনোই কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পরীক্ষা এক সপ্তাহ পেছানো মানে এক মাস পিছিয়ে যাওয়া। এখানে শিক্ষকদের বসে আগের পরীক্ষার সিডিউল ঠিক করে পরীক্ষা নিতে হয়, এতে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়।’
সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক ড. খলিফা মোহাম্মদ হেলাল বলেন, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে হল বন্ধ এবং পরীক্ষা স্থগিত করা হলো। আর পরীক্ষা স্থগিত না করলেও শিক্ষার্থীদের প্রিপারেশন নিতে সমস্যা হতো। এতে শিক্ষার্থীদের রেজাল্টের ওপর প্রভাব পড়ত। আর যে কয়েকটি পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে শিক্ষকরা যদি ক্লোজ রুটিন করে তা থেকে ওভারকাম করা যাবে।’
এ বিষয়ে উপ-উপাচার্য হুমায়ূন কবির বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় যদি অনির্ধারিত সময়ের জন্য বন্ধ হয় তাহলে সেশনজটের আশঙ্কা থেকেই যায়, আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে যাতে করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন দীর্ঘায়িত না হয়। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের উভয়ের চেষ্টার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী ও উপাচার্য ড. এ এম এফ আব্দুল মঈনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে একাধিকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।