The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
শুক্রবার, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪

আত্মহত্যা কি একমাত্র সমাধান?

নাইমুর রহমান: আজকে আমার নিজ বিভাগে চাকরীর বয়সসীমা বাড়ানো শীর্ষক বিতর্ক প্রতিযোগিতা হচ্ছিল । নানা আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসে তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে কত বছরের মধ্যে আজ এই লেখাটা যখন লিখছি আবেগে বুক ভেসে যায় গত রোজায় আমরা হারিয়েছি অবন্তিকাকে। ঠিক ৬ মাসের ব্যবধানে আজকে হারালাম নাট্যকলা বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী ফারহান আহসান চৌধুরীকে।

আত্মহত্যা এই কথাটি যেন প্রচলিত হয়ে গেছে, আর প্রচলিত দেখেই হয়ত সামান্য কিছুতেই আমরা আত্মহত্যার মত ঘৃণ্য সিদ্ধাত নিতেও দুই বার ভাবি না । হতাশ হয়েই করতে চাই আত্মহত্যা ।এসব ছাপিয়েও , কারো রয়েছে ক্যারিয়ারের চিন্তা, কারও বা আবার ভালবাসার কেউ চিন্তিত পরিবার নিয়ে কেউ বা আবার কথার আঘাতে । বিভিন্ন কারণেই মানুষ আত্মহত্যা ঝুঁকে পড়ছে । এখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ আমাদেরকেই ভের করতে হবে ।

বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জ্ঞানের সতীকাগার । আর জ্ঞানই মানুষকে আলোর পথ দেখায় , যে আলো দ্বারা মানুষ সকল অজ্ঞতা থেকে দূরে থাকে , কঠিন সময়কে মোকাবেলা করে ,এবং সফলতার শিখরে আসীন হয় ।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে এই আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে ২০২১ সাল থেকে শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আদ্যবধি আমরা হারিয়েছি ছয়জনকে। তারা ছিলেন শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান

২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সে হিসেবে আত্মহত্যা সূচকের ১ম স্থানে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২য় স্থানে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আত্মহত্যাকারীদের একটা বড় অংশই ছাত্র। মোট ১০১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৫ জনই ছাত্র, অর্থাৎ আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রই ৬৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ছাত্রীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ছাত্র গত বছর আত্মহত্যা করেছে। নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটা ছিল ৩৬ জন বা ৩৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সম্পর্কের অবনতির কারণে আত্মহত্যা করেছে প্রায় ২৪.৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যা বছরের পর বছর বাড়ছে এবং এটি 15-29 বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান মৃত্যুর কারণ। বিভিন্ন দেশের গবেষণায় দেখা গেছে যে, আত্মহত্যার হার পুরুষদের মধ্যে মহিলাদের তুলনায় বেশি, যদিও অনেক দেশে মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। অনেক সংস্কৃতিতে আত্মহত্যা একটি ট্যাবু হিসেবে বিবেচিত হয়, যা ব্যক্তিদের নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে বাধা দেয়। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, বছরে আত্মহত্যার হার এবং এটি প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাদের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ৪০ সেকেন্ডে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে, যা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলে

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দশ হাজার মানুষ আত্মহত্যার কারণে মারা যায়। ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার ৭.৩ প্রতি লাখে প্রতি বছর। ১৩-১৭ বছরের কিশোরদের প্রতি ১০০ জনে ৪ জন এবং কিশোরীদের প্রতি ১০০ জনে ৬ জন আত্মহত্যা করার চিন্তা করে। আত্মহত্যার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে মানুষ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে বা চিন্তা করে।

যাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা আছে তারা অনেক ক্ষেত্রে নিচের আচরণগুলি দেখাতে পারে –

মরে যাওয়ার কথা বলে বা কেউ মেরে ফেললে ভাল হতো বলে মত প্রকাশ করে, প্রায়ই শূন্যতা, হতাশার কথা বলে বা বলে বেঁচে থাকার কোন কারণ বা মানে নেই। আত্মহত্যার পরিকল্পনা করে বা নিজেকে মেরে ফেলার উপায় খুঁজে। যেমন- ইন্টারনেটে আত্মহত্যার উপায় খোঁজা, ওষুধ জমানো, বড়ধরণের অপরাধবোধ, অপমান, গ্লানি অনুভব করা। আবার এমন মনে করা যে এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই বা এই সমস্যার কোন সমাধান নেই। আর আছে , অবর্ণনীয়, অসহ্য মানসিক বা শারীরিক কষ্ট অনুভব করা, নিজেকে অন্যদের বোঝা মনে করে ঘন ঘন মাদক গ্রহণ করা এবং সেথান থেকে উৎকণ্ঠিত, উত্তেজিত বা বিচলিত আচরণ করা এক পর্যায়েপরিবারের সদস্য এবং বন্ধু-বান্ধব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ইত্যাদি।

আত্মহত্যার কারণ বহুবিধ এবং জটিল, কোন একটি নির্দিষ্ট কারণকে চিহ্নিত করা কঠিন। অনেকগুলি বিভিন্নধরণের ঝুঁকি একসাথে যুক্ত হয়ে ব্যক্তিকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। যারা আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তাদের মধ্যে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।–
বিষণ্ণতা রোগ, ব্যক্তিত্বের সমস্যাজনিত রোগ, মাদকাসক্তি ,নিজেকে আঘাত করা, যেমন- শরীরে কাটাকাটি করার প্রবণতা পারিবারিক সহিংসতা, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের ইতিহাস পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব, বিখ্যাত ব্যক্তি, মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের আত্মহত্যা প্রত্যক্ষ করা বা এ সম্পর্কে জানা।

‘কান পেতে রই’ বাংলাদেশে মানসিক সহায়তা বিষয়ক একটি হেল্পলাইন। বেসরকারি এই সংস্থাটি বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত তাদের হেল্পলাইনে ফোন করে কাউন্সেলিং চেয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ।
তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। এই পুরুষদের মধ্যে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি কল করেছেন। সংস্থাটির সমন্বয়ক অরুণ দাস বলছেন, বেশিরভাগই তাদের মানসিক কষ্টের উৎস হিসেবে উপার্জনের চাপের কথা উল্লেখ করেন।

এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় দেশের তরুণ সমাজ দিন দিন আত্মহত্যাতেই যেন তাদের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রকৃত সমাধান ত সেটা নয় । আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি –

সরকারের নীতি এবং সংস্থান, এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতি জরুরি। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা এবং সহায়তার জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

. সচেতনতা বৃদ্ধি
• শিক্ষা কার্যক্রম: স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্য এবং আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
• সামাজিক প্রচারণা: সামাজিক মিডিয়া, টিভি এবং রেডিও মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ক আলোচনা।
. মানসিক স্বাস্থ্য সেবা
• সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন ও সুপারিশক প্রশিক্ষণ সেবা প্রদানের জন্য কেন্দ্র খুলতে হবে যেখানে মানুষ সহায়তা পেতে পারে। স্বাস্থ্য কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো চিহ্নিত ও পরিচালনা করার কৌশল শেখানো দরকার
. সামাজিক সমর্থন
• আত্মহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার ও বন্ধুবান্ধ । পরিবার ও বন্ধুদের গুরুত্ব বোঝানো যাতে তারা একজন প্রিয়জনের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারেন। যারা আত্মহত্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন, তাঁদের সমর্থন দেওয়ার জন্য গ্রুপ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া।
. নীতি এবং আইন
• সরকারি নীতি: আত্মহত্যা প্রতিরোধে সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করা।
• মানসিক স্বাস্থ্য আইন: মানসিক স্বাস্থ্য রোগীদের অধিকার ও সুরক্ষার জন্য একটি আইন তৈরি করা দরকার।
. জরুরি সেবা
• হটলাইন সেবা: হটলাইন প্রতিষ্ঠা করা যেখানে মানসিক চাপ বা আত্মহত্যার চিন্তা করা ব্যক্তিরা দ্রুত ও গোপনীয় সহায়তা পেতে পারেন।
• জরুরি হাসপাতাল সেবা: হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
. গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ
• তথ্য ও পরিসংখ্যান: আত্মহত্যার প্রবণতা এবং কারণে বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া এবং তাদের তথ্য সংগ্রহ করা।
• ঔষধ ও থেরাপির উন্নয়ন: নতুন থেরাপি এবং ওষুধের গবেষণা করে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর চিকিৎসা উন্নীত করা।
. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
• বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে সংযোগ: আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে সমর্থন করার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য গ্রহণ।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ একটি জটিল প্রক্রিয়া যা সামগ্রিক সমাধান ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের জড়িত থাকার প্রয়োজন। একসাথে কাজ করে আমরা একটি নিরাপদ ও সমর্থনমূলক পরিবেশ তৈরি করতে পারি, যা আত্মহত্যা কমাতে সহায়ক হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.