নিজস্ব প্রতিবেদক: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) তাহমিন ওসমান নামে এক নবীন শিক্ষার্থীকে ফের র্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। তামিম ২০২২-২৩ (স্নাতক) প্রথম বর্ষের হিউমান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন প্রফেসর সাইফুল ইসলামকে আহ্বায়ক ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার (শিক্ষা) আলীবদ্দীন খানকে সদস্য সচিব করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন,ছাত্র উপদেষ্টা প্রফেসর ড. শেলিনা নাসরিন, আইন বিভাগের প্রফেসর ড. আনিচুর রহমান ও ফিনান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রভাষক মিথুন বৈরাগী। কমিটিকে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানা যায়।
এর আগে আজ (রবিবার) সকালে ভুক্তভোগী তার বাবাকে সাথে নিয়ে রেজিস্ট্রার, ছাত্র উপদেষ্টা, প্রক্টর ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বাবা শওকত খান।
অভিযোগপত্র সূত্রে জানা গেছে, গত ২ সেপ্টেম্বর ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের পর ২০২১-২২ সেশনের কিছু সিনিয়র ছাত্র ভুক্তভোগীকে র্যাগিং করেন এবং চরম খারাপ ব্যবহার করেন। এদিন ভুক্তভোগীকে দেড়টার দিকে ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের পর জিমনেশিয়ামের পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় পরিচয় কীভাবে দিতে হয় তা শেখানো শুরু করে। অভিযুক্তরা তার হাত-পা সোজা রাখতে বলেন। কিন্তু ভুক্তভোগীর হাত একটু মুঠ করায় অভিযুক্তরা বলেন, ‘তোর কী আমাদেরকে থাপড়াইতে ইচ্ছে করছে তাই না? তোর খুব জিদ উঠছে তাই তো?’ এমতাবস্থায় ভুক্তভোগী সরি বললে তারা পাল্টা বলেন, ‘সরি বলিস কেন? তুই কী ভুল করেছিস বল? আমাদেরকে ভয় করবি কেন? আমরা কী ভূত ? বল আমরা ভূত?’
সেইদিন পরিচয় গ্রহণ শেষে ভুক্তভোগীকে অভিযুক্ত শুভ বলেন, ‘ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় এই স্থানেই আসবি, না আসলে আলাদা রুমে ডেকে নিয়ে যাবো।’ ওইদিন ভুক্তভোগী সন্ধ্যায় হাজির হন এবং সিনিয়ররা তাকে সাদ্দাম হোসেন হলের বিপরীতে নিয়ে বসেন। এ সময় পূনরায় পরিচয় দিতে বললে সে পরিচয় দেওয়া শুরু করে। এসময় ভুক্তভোগী সবার দিকে তাকিয়ে সালাম দিতে না পারায় অভিযুক্ত মিজানুর ইমন তাকে বলেন, ‘তুই শুধু ওদের দিকে তাকিয়েই সালাম দিলি, আমাদের দিকে তাকালি না। এর মানে শুধু ওরাই তোদের বড়ভাই আর আমরা তো তোর…. (প্রকাশে অযোগ্য) ভাই।’
তখন আরেক অভিযুক্ত আকিব তাকে বলেন, ‘তুই তো আমাদের বড় ভাই তাই না? আমাদের সালাম দেওয়া লাগবে না।’ এমতাবস্থায় অভিযুক্তদের মধ্যে কোনো একজন চলে যাচ্ছিলেন যা ভুক্তভোগীর দৃষ্টিতে আসেনি। এসময় উপস্থিত অভিযুক্ত শুভ তাকে বলেন, ‘ওই দেখ তোর বড় ভাই চলে যাচ্ছে, তাকে সালাম দিলি না কেন? সে তো রাগ করেছে। এখন যা ওকে গিয়ে কনভিন্স কর যা। কীভাবে করবি তোর ব্যাপার।’ তখন ভুক্তভোগী তাদের এই কথা না শোনায় অভিযুক্ত মিজানুর ইমন তাকে বলেন, ‘তুই বলবি যে তুই একটা…..(প্রকাশে অযোগ্য)।’ সে অনুরুপ তাই করলো । এবার ওই অভিযুক্ত বলেন, ‘এমন ভাবে নিজেকে…. (প্রকাশে অযোগ্য) বল যেন তুই উল্লাস করছিস।’ সে তাই করলো। এবার আরেক অভিযুক্ত পুলক তাকে বলেন, ‘তুই বলবি যে তুই একটা…. (প্রকাশে অযোগ্য), অনুরূপভাবে ৩ বার বলবি।’ এগুলো করার পর অভিযুক্ত মিজানুর ইমন তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোর কী….(প্রকাশে অযোগ্য) আছে?’ ভুক্তভোগী কোনো জবাব দেয়নি। এবার ওই অভিযুক্ত বলেন, ‘….(প্রকাশে অযোগ্য) মানে কী বল।’ সে (ভুক্তভোগী) গাম্ভীর্য অবলম্বন করেন। এতে ওই অভিযুক্ত রেগে গিয়ে তাকে বলেন, ‘তুই কি মুখে…..(প্রকাশে অযোগ্য) ঠুসে রেখেছিস? কথা বলিস না কেন?…..(প্রকাশে অযোগ্য) মুখে ঠুসে রেখেছিস। তুই ১০ রকমের হাসি দিবি, নাম সহ। ভুক্তভোগী এরুপ করতে অসম্মতি জানাই। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তাকে আটকে রাখেন তারা।
ওইদিন দুপুরে তাকে যখন র্যাগ দেওয়া হচ্ছিল, তখন ক্যাম্পাসে মাইকিং হচ্ছিল, ‘র্যাগিং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে’। একথা শুনে সে হেসে দেওয়ায় অভিযুক্তরা তাকে বলেন, ‘আমাদেরকে হাস্যকর মনে হয় তোর? অনেক বন্ধুসূলভ আচরণ করে ফেলেছি তাই তো? তুই তো আমাদের বড় ভাই।’
অভিযোগ পত্রে আরও বলা হয়, গত ৩ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩ টায় হিউমান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। ওইদিন ভুক্তভোগী যেতে দেরি করেন। খেলা শেষে অভিযুক্ত শুভ ও সাকিব তাকে জিমনেশিয়ামের সামনে নিয়ে যান এবং জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন দেরী করেছি।’ সে বলেন, ‘আমি ক্লান্ত ছিলাম।’ প্রত্যুত্তরে অভিযুক্ত শুভ বলেন, ‘আমরাও তো সকালে না খেয়ে খেলাধুলা করে তোকে নিয়ে বসলাম, আমাদের কী ক্লান্ত লাগে না? তোর আসতে এত অসুবিধা কেন? বেশ ভালো ব্যবহার করে ফেলেছি ? আমাদের সাথে আমাদের বড়ভাইরা যা করেছিলো, তোর ওপরও সেরকম করতে বাধ্য করিস না।’ ওইদিন ভুক্তভোগী মাগরিব-এর পর অভিযুক্তদের সাথে আর দেখা করেন নি।
গত ৫ সেপ্টেম্বর ক্লাস শেষে ভুক্তভোগীকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় জিমনেশিয়ামের পাশে। এসময় ভুক্তভোগী কেন অভিযুক্তদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেয় নি এজন্য তাকে বকা দেওয়া হয়।
অভিযুক্তরা বলেন, ‘যদি আমাদের কথা না মানিস, তোকে ব্যাচ-আউট করে দেওয়া হবে। ব্যাচ-আউট কী বুঝিস? তুই এইচআরএম বিভাগের ছাত্র হিসেবে কোনো সুযোগ সুবিধা পাবি না। সবাই বলে বেড়াবে যে তুই ব্যাচ-আউট স্টুডেন্ট । আর আমাদের মধ্যে কাউকে চিনিস? আমাদের অনেকেই অনেক উঁচু পজিশনে আছে। তাদের ক্ষমতা জানিস?’ তারা এগারোটা হতে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত ভুক্তভোগীকে এসকল কথার মাধ্যমে হয়রানি করেন। এসময় ভুক্তভোগী মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেন, ‘আমার দুপুর ৩ টায় ট্রেন আছে।’ এটা বলে কোনোরকম মুক্তি নিয়ে ফিরে আসেন ওই ভুক্তভোগী।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। রবিবার প্রক্টর ও এন্টি র্যাগিং ভিজিলেন্স কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, আমি ওই শিক্ষার্থীর বিভাগের সভাপতির নিকট পত্র প্রেরণ করেছি। যাতে করে তার ক্লাস-পরীক্ষায় সভাপতিসহ ওই বিভাগের শিক্ষকগণ তার দেখভাল করেন। সহকারী প্রক্টর শরিফুল ইসলামকে শিক্ষার্থীর সার্বিক নিরাপত্তার জন্য খোঁজ খবর রাখতে নির্দেশনা দিয়েছি। ইবি থানার ওসিকে পত্র প্রেরণ করেছি যাতে তার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে। এছাড়া ওই শিক্ষার্থীর বাবা তার সন্তানের নিরাপত্তার জন্য হলে একটি সিটের বিষয়ে বলেছিলো ফলে আমরা হল প্রভোস্টকে পত্র প্রেরণ করেছি। হল প্রভোস্ট মিটিং করে আগামীকাল ওই ছেলেকে হলে তোলার কথা রয়েছে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ডিন প্রফেসর সাইফুল ইসলাম বলেন, চিঠিটা আমি এখনো পাইনি। রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে জেনেছি। চিঠিটি হাতে পাওয়ার পর আগামীকাল থেকে আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করবো।
এ বিষয়ে জানার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) এইচ এম আলী হাসানকে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায় নি।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তাহমিন ওসমানের বাবা তার সন্তানকে র্যাগিংয়ের বিষয়টি উল্লেখপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয় ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এইচ এম আলী হাসান বরাবর মেইল করেন।