নাগরিক জীবনের বহুবিধ অনিশ্চয়তা ও জলবায়ু নামক খ্যাপা জন্তুর প্রহরণের ভেতর দিয়ে আমাদের টিকে থাকার সবেধন নীলমণি হচ্ছে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বলতে সতত খাদ্যের লভ্যতা ও মানুষের খাদ্য ব্যবহারের অধিকারকে বোঝায়। নিউলিথিক, আরব ও ব্রিটিশ কৃষি বিপ্লবের হাতধরে নরমান বোরলগের সবুজ বিপ্লবের ছোঁয়ায় বদলে গেছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার কৌশল; পেশি শক্তির পরিবর্তে প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষিতে এসেছে স্বয়ম্ভরতা। যেকোন যন্ত্র এবং প্রাকৃতিক উপাদান সম্বন্ধে জ্ঞান ও তা দক্ষভাবে ব্যবহারের ক্ষমতাই প্রযুক্তি। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার পাঁচটি মৌলিক জায়গায় প্রযুক্তির ব্যবহার দেদীপ্যমান:
ক. বৈরী জলবায়ু মোকাবিলা করে সাশ্রয়ী ও সুলভ মূল্যে পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্তি সুনিশ্চিত করা।
খ. জিনোম সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে রোগপ্রতিরোধী ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন।
গ. রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, খাদ্য সংরক্ষণ, মৃত্তিকা-ফসল দূষণ নির্ণয় ও দূরীকরণ, সেচের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
ঘ. খাদ্য বহুমুখীকরণ ও জ্ঞান-গবেষণা সমৃদ্ধ টেকসই কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষা প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি করা।
ঙ. পরিমিত পুষ্টিমান অর্জনের লক্ষ্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য গ্রহণ ও খাদ্যের জৈবিক ব্যবহার বৃদ্ধি করা।
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কৃষিতে ড্রোনের ব্যবহার থেকে শুরু করে ট্রান্সজেনিক প্রযুক্তি, ন্যানো প্রযুক্তি কিংবা ইনডোর ভার্টিক্যাল ফার্মিং, মডার্ন গ্রীন হাউজ, প্রিসিশন এগ্রিকালচার, GI, AI, 3D-DAM, SRDI, AICC, পাস্তুরাইজেশন, রাইস ক্রপ ম্যানেজার অ্যাপস, আইএফএস, হারভেস্টর, ট্রান্সপ্ল্যান্টার, রোবাটিক ডেইরি, লাইভস্টক ফার্মিং টেকনোলজি ও ফার্ম অটোমেশন নামক প্রযুক্তির ব্যবহারে:
ক. খাদ্যশস্যের উৎপাদন বছরান্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে দুই থেকে তিন গুণ।
খ. পশু চিকিৎসা ও ফসলের রোগ নিরাময়ে প্রতিভাত হচ্ছে যুগান্তকারী পরিবর্তন।
গ. হেক্টরপ্রতি সবজি, ফল, ধান ও গমের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন গুণ।
ঘ. ডেইরি, পোল্ট্রি, এ্যানিমেল হাসবেন্ড্রি ও ফিসারিজ সেক্টরে উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণেরও বেশি।
ঙ. প্রযুক্তির উৎকর্ষতা রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে কৃষকদের দৃষ্টিভঙ্গিকে করেছে প্রসারিত ও বিচিত্রগামী।
চ. ই-কৃষির ফলে বিশ্বব্যাপী কৃষি শিল্পে প্রসারিত হয়েছে বহুমাত্রিক বাজার, বাড়ছে দক্ষতা, নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে খাদ্যের গুণগত মান।
বাংলাদেশে বছরান্তে ০.৪ হারে কমছে কৃষিজমি, বিপরীতে যুক্ত হচ্ছে ২২ লাখ নতুন মুখ। এ অবস্থায় জমি বা খামারের সবোর্ত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে দরকার সমন্বিত চাষ পদ্ধতির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রকল্প ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি। খাদ্য নিরাপত্তার এই পরিমণ্ডলে একজন কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি দাঁড় করিয়েছি একটি সমীকরণ: Green Technology = Food Security + Nutrition Security = Accessibility + Availability + Production + Distribution of safe Food = Sustainable Agriculture = Full employment + Better future. সবুজ শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহারে একদিকে যেমন বাড়ছে ফলন, তেমনিভাবে কমছে খাদ্যের অপচয়; কৃষকের পাশাপাশি গণমানুষের মনেও প্রযুক্তি দিচ্ছে সচেতনতার দোলা। নৃবিজ্ঞানী এরিক উলফের Open Peasnat এর সাথে বর্তমান কৃষকদের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। বস্তুত প্রযুক্তিবিহীন কৃষি কিংবা খাদ্য নিরাপত্তা যেন কচুবনের কালাচাঁদ। জাতিসংঘ ফুড সিস্টেমস সামিট ২০২১ এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫ টি প্রস্তাবের একটি ছিল খাদ্য নিরাপত্তায় প্রযুক্তির বিনিময় সুনিশ্চিত করা। ২০০০ সালের জুলাইয়ে নেদারল্যান্ডসে ‘Adoption of Technologies for Sustainable Farming Systems’ কর্মশালায় সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহারের যে তাগিদ এসেছিল, আসুন তা পূরণ করি। প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি নয়, দরকার কৃষিবান্ধব প্রযুক্তি, আরো সবুজ আলোর প্রত্যাশা নিয়ে শেষ করছি এই বলে: সবুজ আলোয় প্রদীপ্ত হলে সবুজ ভূমি, তবেই বাঁচব তুমি আমি।
লেখক: ফাহাদ হোসেন ফাহিম, শিক্ষার্থী, পশুপালন অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়