কাজী বনফুলঃ বিট্রিশদের হটিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকেই সমগ্র ভারতবর্ষ ব্যাপি শ্রেণী বৈষম্য প্রকট হতে থাকে। এই শ্রেণী বৈষম্যে এক দল উপভোগ করেছে ক্ষমতার সর্বোচ্চ রসগোল্লা এবং আরেকদল সর্বদা চুষেছে রসগোল্লা থেকে ঝড়ে পড়া ঝোল।
এই ঝড়ে পড়া ঝোল থেকে বেড়িয়ে এসে নিজেকে রসগোল্লাময় করে তুলতে ভারতবর্ষের মানুষের সংগ্রাম সেই অনেক আগে থেকেই এবং তা বর্তমানেও চলমান রয়েছে।
সম্প্রতি ভারতে সত্য ঘটনার উপর ভিদু বিনোদ চোপরা 12th fail নামক একটি সিনেমা তৈরি করেছেন। এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে সেই শ্রেণী সংগ্রামের শিকার হওয়া একটি পরিবারের গল্প।
সে পরিবারে মনোজ নামের একটি চরিত্র হচ্ছে সিনেমার মূল উপযোগ। যার জীবনের একটি নির্দিষ্ট সংগ্রামের উপর নির্মাণ করা হয়েছে 12th fail চলচ্চিত্রটি।
আমরা যদি মনোজ এবং মনোজের পরিবারের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো মনোজ ও তার পরিবারের সাথে হওয়া অন্যায় বা অত্যাচারের বিরুদ্ধে মনোজ নিজেকে এমন একটা জায়গায় দাঁড় করাতে চেয়েছে যেখান থেকে তাদের উপর করা অত্যাচারীদের সকলকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছে যে মনোজ এবং মনোজের পরিবার এই সমাজেরই বিশেষ একটি অংশ।
সিনেমার গল্পের যথার্থ বুননের প্রয়োজনে ও সেই সাথে দর্শকের হৃদয়ে সস্তা করুনার সৃষ্টিসহ এই সিনেমার গল্পে যে অনেক বিষয় অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়নি সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা মুশকিল।
সেটা যাই হোক, 12th fail সিনেমায় যে বিষয়ের উপর মোটিভেট করা হয়েছে সেই বিষয়ের উপর সমগ্র ভারতবর্ষ এমনিতেই মোটিভেটেড। কারণ আমাদের এই অঞ্চলে পড়াশোনা করার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিশেষ কোন বিষয়ের উপর নিজের জীবনের মূল্যবান সময়কে বিসর্জন দিয়ে অর্জন করতে মরিয়া কোন বিশেষ রসগোল্লা।
লক্ষ লক্ষ মনোজের ভেতর থেকে একজন মনোজের সফলতায় আমরা আনন্দিত হই, উচ্ছসিত হই। কিন্তু তার বিপরীতে ঝড়ে পড়া লক্ষ লক্ষ মনোজকে আমরা আসলে কোন চোখে দেখি। আমরা মনোজের শেষ বারের দেওয়া IPS পরিক্ষায় পাশ করার পর তার অশ্রুতে অশ্রু সিক্ত হয়ে পুলকিত হই কিন্তু তার বিপরীতে শেষবারে হেরে যাওয়া মনোজদের দিকে ফিরেও তাকাই না। মনোজ যদি মনোজ না হয়ে উঠতো তাহলে তাকে নিয়ে কিন্তু সিনেমা হতো না। এর চেয়ে আরো কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে অনেকে অথচ তাদের নিয়ে কিন্তু কোন সিনেমা হয়নি। কারণ পরিচালক বুঝতে পেরেছে যে কাদের কোন খাবার খেতে দিতে হবে এবং কখন দিতে হবে যথার্থ মসলা সমেত।
আমাদের এত উচ্ছাসিত ও কৌতহূলী হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে আমরা আমাদের মনের অজান্তে নিজের ভেতরে থাকা মনোজকে সিনেমার মনোজের ভেতরে স্থাপন করে তার জয় কে নিজের জয় বলে মনে করে জয়ী হয়ে উঠা। আজ মনোজকে পিক করা যে গৌরী ভাইকে আমরা এখানে দেখেছি এমন পিক করার মত বন্ধু কি আমাদের সমাজে খুঁজলে খবু বেশি পাওয়া যাবে, না তার সম্ভাবনা খুবই কম। বেকার বলে প্রেমিকের হাত ছেড়ে দেওয়ার গল্পই আমাদের সমাজে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্যই বটে।
একজন মনোজকে দিয়ে সামগ্রিক মনোজকে বিচার করা একদমই সুবিচার হবে না। আমি এমন এমন মনোজকে চিনি যারা জীবনের সর্বোচ্চ সংগ্রামের পরেও তারা মনোজ হয়ে ওঠতে পারেনি অথচ তাদের কথা কেউ মনেও রাখেনি কারণ তারা অবশেষে আলহামদুলিল্লাহ নামক জয়ের বার্তা সকলের সামনে তুলে ধরতে পারেনি যার ফলে তাদের জীবনে কখনো অভিনন্দন নামক মরিচীকার সাক্ষাৎ মেলেনি।
আমাদের সমাজের পড়াশোনা শেষ করা একটা ছেলে এমনিতেই সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছে মোটিভেশন ও প্রতিযোগিতা নামক একপ্রকার বিশেষ মৌহের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে। তাদের জীবনের প্রেম, আনন্দ, সুখ সব কিছু কেড়ে নিয়েছে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার সিস্টেম যা তাদের তৈরি করছে তাজা গোলাপ থেকে শুষ্ক গোলাপে।
কোন সমাজে যখন এক কেন্দ্রীক কোন কিছুর প্রতি যুব সমাজকে ধাবিত করা হয়। কোন বিশেষ কিছু অর্জনের প্রতি সমাজ তরুণদের চিন্তাকে ফিক্সড করে দেয়। তাদেরকে মানসিক ভাবে কোন বিশেষ মুলার প্রতি লোলুভ মানসিকতা তৈরি করে দেয়। তখন সে সমাজে একটি বৈষম্য মূলক ব্যবস্থা তৈরি হয়। তখন সে সমাজে একটি ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়। সে সমাজে তখন একটি ক্ষমতার বৈষম্য তৈরি হয়। যে শ্রেণী বৈষম্যের জন্য আজীবন সংগ্রাম সেই শ্রেণী বৈষম্যের অবসান না হয়ে বরং আরো বেশি বেশি বৃদ্ধি পায় তখন। যার কারণে সে সমাজ ব্যবস্থা ভঙ্গুরতার দিকে অগ্রসর হয় যেটা আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ের ভারতবর্ষে। তাই বর্তমান বিশ্ব যেখানে শ্রেণী বৈষম্যকে নাকচ করে সমানুপাতিক মনভাবের দিকে ঝুঁকছে ঠিক সেই সময় 12th fail সিনেমা আমার কাছে অনেক বেশি অপ্রাসঙ্গিক ও ব্যাকডেটেট মনে হয়েছে।
যেখানে আমরা এমনিতেই একটি অমানবিক প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে রোবটিক হয়ে উঠছি সেখানে 12th fail সিনেমা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আরো বেশি বেশি সেই দিকেই ঠেলে দিচ্ছে, তাদেরকে আরো বেশি বেশি ঐ দিকেই ধাবিত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করছে যা ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে টিকে থাকার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে।
বেকারত্বের অভিশাপ নামক যে প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে আমাদের অঞ্চলে তা কিন্তু নির্দিষ্ট কোন এক কেন্দ্রীক কর্মের পেছনে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অপব্যয়ের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। কারণ লাখ লাখ তরুণ যখন কোন একটি বিশেষ ফুল কে অর্জনের জন্য যুদ্ধ করে তখন কেউ একজন সেটা অর্জন করে ফেললে বাকিরা হতাশায় ডুবে গিয়ে সেই একজনের প্রতি সকলের ভেতরে একটি ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ফলে তাদের ভেতর আর অন্য কিছু করার মত শক্তি বা ইচ্ছা কোনটাই অবশিষ্ট থাকে না। ফুলটি এতই সুগন্ধিযুক্ত যার কারণে ব্যর্থ হওয়া সবাই সে ফুলটি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং তারা ঠিক তখনই বয়স বাড়ানোর আন্দোলন করে সেই ফুল অর্জনের জন্য আরো সময় ধার্য করতে চায়। যার ফলে সে অধরা ফুলের পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবনের মহামূল্যবান সময় তারা হারিয়ে পরিনত হয় নিজেই নিজের বোঝায়।
এই আধুনিক পৃথিবীর আধুনিক সময়ে আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে কোনটা আমাদের জন্য পুষ্প এবং কোন কণ্টক, কোনটা পানি আর কোনটা এসিড, এই ব্যবধান আমরা না বুঝলে অন্যের চাপিয়ে দেওয়া পাশার দানে পরিনত হতে আমাদের কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমরা কেবলই অন্যের পাশার গুটি হয়ে বেঁচে থাকবো।
কাজী বনফুল, লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক/