সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের ছাত্রীদের তিন দফা দাবি আদায়ে চলমান কর্মসূচিতে হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনরত ছাত্রীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। আজ রোববার সকাল পৌনে নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে ছাত্রীরা আগের দিনের মতো ফের সড়ক অবরোধ করে নতুন এই কর্মসূচির কথা জানান। এ সময় সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রাধ্যক্ষদের পদত্যাগ, হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা দূর করে সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত এবং ছাত্রীবান্ধব ও দায়িত্বশীল প্রাধ্যক্ষ কমিটি নিয়োগের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে আন্দোলন করেন ছাত্রীরা।
আজ সকাল পৌনে নয়টার দিকে অর্ধশতাধিক ছাত্রী গোলচত্বরে এসে অবস্থান নেন। এ সময় তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রধান রাস্তা ‘কিলো সড়ক’ অবরোধ করে তিন দফা দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রাধ্যক্ষদের পদত্যাগ চেয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে অনেক ছাত্রী অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন। আন্দোলনরত ছাত্রীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের প্রতিনিধিদের একাত্মতা প্রকাশ করে কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেখা গেছে। এরও আগে গতকাল শনিবার রাত ১২টার দিকে আন্দোলনের সঙ্গে নৈতিকভাবে একাত্মতা প্রকাশ এবং শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সংগঠনের ফেসবুক পেজে বিবৃতি দিয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
অবরোধ শুরুর পর থেকে সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত সিলেট শহর ও শহরতলির বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সময় নয়টি বাস ছাত্রীরা কিলো সড়কে আটকে দেন। একই সময়ে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত গাড়িও শিক্ষার্থীরা ভেতরে ঢুকতে দেননি। সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে ‘প্রক্টরের উপস্থিতিতে হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই, ‘হামলা করে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না’, ‘সাস্টিয়ান সাস্টিয়ান, এক হও লড়াই করো’, ‘ছাত্রলীগের হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘তিন দফা তিন দাবি, মানতে হবে মেনে নাও’, ‘প্রভোস্ট বডির পদত্যাগ, করতে হবে করতে হবে’ উল্লেখযোগ্য।
কয়েক ছাত্রী কাছে অভিযোগ করেছেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে গতকাল সন্ধ্যায় হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন। এতে অনেকে আহতও হয়েছেন। তিন দফা দাবি আদায় না হলে ছাত্রীরা আন্দোলন থেকে সরবেন না।
চতুর্থ দিনের মতো ছাত্রীদের আন্দোলনে নামার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গতকালও দেখা করে কর্মসূচি থেকে সরে আসার অনুরোধ করেছি। এর আগে উপাচার্য স্যার আন্দোলনরত ছাত্রীদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করে প্রাধ্যক্ষ কমিটির পদত্যাগের বিষয়টি ছাড়া সব কটি দাবি এক মাসের মধ্যে সমাধানের আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু ছাত্রীরা বলছেন, পুরো প্রাধ্যক্ষ কমিটির পদত্যাগ করতে হবে। আসলে খুঁজে খুঁজে সব ম্যাডামকে এনে অনুরোধ করে করে হলগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা নিজেদের সংসার-কাজ ফেলে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনও করছেন। এখন প্রাধ্যক্ষ কমিটি যদি বাদ দিতে হয়, তাহলে কাদের দিয়ে কমিটি করব? আমরা ছাত্রীদের বলেছি, ছাত্র-শিক্ষকের যে সম্পর্কের জায়গা, তাতে যদি তোমরা কষ্ট পেয়ে থাকো, দেখবে সেটা আন্তরিকতার মধ্য দিয়েই কেটে যাবে। আর বাকি সমস্যাগুলো তো দ্রুততার সঙ্গেই সমাধান করা হচ্ছে।’
মো. আনোয়ারুল ইসলাম আরও বলেন, ‘অমিক্রন নিয়ে আতঙ্ক আছে। এভাবে ছাত্রীরা সমাবেশ করলে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ কারণে ছাত্রীদের হলে ফিরে যাওয়ার জন্য আবারও অনুরোধ জানাচ্ছি।’
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের শতাধিক ছাত্রী প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ ওরফে লিজার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। পরে উপাচার্য গত শুক্রবার দুপুরে ছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলে দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে বিক্ষোভ স্থগিত করে তাঁরা হলে ফেরেন। এরপর গত শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে আন্দোলনরত ছাত্রীদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে উপাচার্য বৈঠক করেন।
বৈঠকে ছাত্রীদের প্রতিনিধিদল উপাচার্যের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ উত্থাপন করে তিন দফা দাবি তুলে ধরে। এরপর শুক্রবার বিকেলে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলে ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ দেয় কর্তৃপক্ষ। তখন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ অসুস্থতার কারণে ছুটিতে থাকায় হলে ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ হিসেবে আরেকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর ছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। তাঁদের সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে।
তবে উপাচার্যের সঙ্গে ওই বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি জানিয়ে আবার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন ছাত্রীরা। পরে শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে ছাত্রীরা সংবাদ সম্মেলন করে দাবি মানতে গতকাল সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। গতকাল বিকেল সোয়া পাঁচটা থেকে ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা জহির উদ্দীন আহমেদ ও প্রক্টর আলমগীর কবিরের সামনেই ছাত্রীদের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালান বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর গতকাল রাত দেড়টা পর্যন্ত ছাত্রীরা গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে তিন দফা দাবিতে স্লোগান দেন।
এ সময় ছাত্রীরা ক্যাম্পাসে মশাল মিছিলও করেন। রাত দেড়টার দিকে ছাত্রীরা হলে ফেরেন। এর আগে তাঁরা জানান, হামলার প্রতিবাদে আজ থেকে আন্দোলনরত ছাত্রীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের পাশাপাশি সকাল আটটা থেকে গোলচত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন।