গত ৪ আগস্ট ঠাকুরগাঁও কোর্টচত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন লিটন। সেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল লিটনের পুরো শরীর।
বর্তমানে লিটনের চিকিৎসা, সুস্থ হওয়া ও তার কাজে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে না পেরে মৃত্যুর যন্ত্রণা নিয়ে কাতরাচ্ছে লিটন। অভাবের সংসারে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে খন্ডকালীন চাকরি করতেন একটি ঔষধ দোকানে। সেই চাকরিও এখন হারিয়েছেন ।
চিকিৎসক বলছেন, লিটনের শরীরে এখনও প্রায় ৫০০ গুলি রয়ে গেছে। সেই গুলি বের করা সম্ভব না হওয়ায় এখনো হাঁটতে পারছেন না।
লিটনের বাড়ি ঠাকুরগাঁও শহরের মিলন নগর মহল্লায়। বাবা ইয়াকুব আলী। তিন ভাইয়ের মধ্যে লিটন সবার ছোট। তিনি ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। তার বাবা স্যানিটারি স্লাব বিক্রি করে সংসার চালান।
সেদিনের রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে লিটন বলেন,ছাত্রদের ডাকা সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
গত ৪ আগস্ট দুপুরে কোর্ট চত্বরের পূর্ব পাশের একটি গলিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অবস্থান করে। এ সময় পুলিশ তাদের গুলি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলে। চলে যাওয়ার সময় পিছন দিক থেকে লিটনের মাথায় গুলি করে পুলিশ। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এতে কিছু সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে জ্ঞান ফেরার পর উঠে দাঁড়ালে পুলিশ তাকে আবারও খুব কাছ থেকে এলোপাতাড়ি ছোররা গুলি করতে থাকে। এতে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্ত শরীর গুলিবিদ্ধ হয়।
এ সময় কোন রকম হামাগুড়ি দিয়ে পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই বাড়ির লোকজন লিটনের রক্ত ঝরা মাথায় কাপড় দিয়ে বেধে দেন। বাড়ির লোকজনকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বারবার আকুতি জানাচ্ছিল লিটন। তবে তাকে পুলিশের ভয়ে হাসপাতালে নেয়নি কেউ। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাকেসহ গুলিবিদ্ধ অন্যদের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান বলে জানান লিটন। সেখানেও ভালো চিকিৎসা পাননি তিনি। পরে ওইদিন শহরের একটি ক্লিনিকে অস্ত্রপচার করে ১২টি গুলি বের করা হয়।
তখন পুলিশ ও ছাত্রলীগের ভয়ে ক্লিনিক ছাড়তে হয় তাকে। পরে ৬ তারিখ পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। সেখানে তিন দিন চিকিৎসার পর রংপুর সেনাবাহিনী পরিচালিত সিএমএইচ হাসপাতালে দুই সপ্তাহ ভর্তি থাকেন। তবে সেখানে অস্ত্রপচার করে শরীর থেকে একটিগুলিও বের করা যায়নি। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে এখন বাড়িতেই অবস্থান করছেন।
লিটনের বাবা ইয়াকুব আলী বলেন, অভাবের সংসারে ধার-দেনা করে ছেলের জন্য ওষুধ কিনতে হচ্ছে। বড় স্বপ্ন ছিল ছেলেটা পড়ালেখা শেষ করে একদিন সংসারের হাল ধরবে। পরিবারের অভাব দূর হবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন কি এক ঘটনায় মিশে গেল ।
পুরো শরীর জুড়ে গুলির ব্যাথায় ছটপট করতে থাকা লিটন বলেন, গুলি লাগার পরে শরীরের প্রত্যেকটা জায়গা যেন অবশ হয়ে আছে। কোন কাজ কাম করতে পারিনা। যা কিছু করতে হয় একজন মানুষের সহযোগিতায় করতে হয়। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারি না বসেও থাকতে পারি না। আবার গরম লাগলে ব্যাথার তীব্রতা বেড়ে যায়। সারাক্ষণ বাতাস ও ঠান্ডা জায়গাতে থাকতে হয়। রাতে ঘুমাতে গেলে মাথায় বিদ্ধ গুলির যন্ত্রণায় ঘুম হয় না। বালিশও মাথায় দেওয়া যায়না। সরকারের কাছে আমার একটাই চাওয়া আমি যেন সুস্থ হয়ে বাবা-মার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।
লিটনের বর্তমান চিকিৎসক ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. শিহাব মাহমুদ শাহরিয়ার বলেন, ছররা গুলি যদি খুব অসুবিধা না হয় তাহলে এ সব গুলি বের করতে অনুৎসাহিত করি। কারণ মাথায় যে ১৫টি গুলি আছে এর জন্য ১৫ বার তার অস্ত্রপচার করতে হবে। এতে রোগীর আরও জটিল অবস্থা তৈরি হবে। এছাড়াও গুলি গুলো খুবই ছোট,কেটে সঙ্গে সঙ্গে বের করা যাবে এমনটিও না। প্রতিটি গুলি খুঁজে বের করা খুব ক্রিটিক্যাল এবং রোগী ও ডাক্তারের জন্যও কষ্টকর। তবে কোন গুলির কারণে শরীরে ইনফেকশন বা পুঁজ বের হলে তখন সেটা আমরা বের করে চিকিৎসা দেই। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক গুলি বের করা একে বারে সম্ভব না।
ঠাকুরগাঁওয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতদের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল উইংয়ের দায়িত্বরত সদস্য রাকিব ইসলাম বলেন, উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে লিটনের শরীরের গুলি গুলো যদি বের করা যায় তাহলে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তবে এই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ যা জোগাড় করা সম্ভব নয় তার দরিদ্র পরিবারের পক্ষে। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের কাছে তার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন তিনি।