কাজী বনফুলঃ সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহাতাব সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্য বই থেকে দু’টি পৃষ্ঠা সকলের সম্মুখে ছিঁড়ে ফেলেছেন এবং সকলকে তা ছিঁড়ে ফেলার জন্য উৎসাহিত করেছেন। সে বইয়ের পৃষ্ঠায় ছিল তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া সম্প্রদায় নিয়ে রচিত শরিফা নামক একটি গল্প। সে পৃষ্ঠা ছেঁড়া নিয়ে তুমুল আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
যে শিক্ষক গল্পটি ছিঁড়ে ফেলেছেন তিনি সম্ভবত মনে করেছেন এটি কোন ঝালমুড়ি বা কোন রাস্তায় পড়ে থাকা কোন সস্তা কাগজ যা তিনি চাইলেই ছিঁড়ে ফেলতে পারেন। এটা যে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্মিত কোন বই তা তিনি একবারও ভাবেন নি। কোন বই প্রণীত হয় একটি বিধিবদ্ধ পদ্ধতির ভেতর দিয়ে। বইতে যদি কোন অযাচিত বা দৃষ্টিকটু বিষয় থাকে তাহলে কর্তৃপক্ষ সে বইকে আবার পুনঃ মুদ্রণ করেন বা সংশোধিত করেন। যদি তারা আলোচনার দ্বারা পরিবর্তন করার দরকার অনুভব করেন।
সেক্ষেত্রে এখানে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি গল্পটি ঐ শিক্ষকের মন মত বা তার মানসিক চিন্তার উপযোগী না হওয়ার দরুন তিনি নিজ হাতে গাছের তেঁতুল মনে করে ছিঁড়ে ফেলেছেন ঐ বইয়ের পাতা।
কোন বই কারো পছন্দ হলো না তাই বলে সেটা কি ছিঁড়ে ফেলার অধিকার রাষ্ট্র তাকে অর্পণ করেছে? অবশ্যই করেনি। কোন মানুষ যদি কারো অপছন্দ হয় তাহলে কি সে ঐ মানুষকেও ছিঁড়ে ফেলবে অবশ্যই নয়। কারো যেটা যেটা পছন্দ হয়নি কোন এক জনের তো সেটা পছন্দ হতেই পারে। তাহলে অন্যের পছন্দের মতকে ছিঁড়ে ফেলার অধিকার সে কোথায় পেয়েছেন এবং সেটা তিনি ছিঁড়েছেন সকলের সম্মুখে। তিনি নিজের ইচ্ছা স্বাধীন বইটি ছিঁড়ে এবং সবাইকে বই ছেঁড়ার জন্য উৎসাহিত করে মারাত্মক অপরাধ করেছেন । কারণ সে বই ছেড়াঁর কারণে যদি কোন সাজা না পায় তাহলে পরবর্তীতে যে কারো কোন বই বা পৃষ্ঠা পছন্দ না হলে সে ঐ বই বা পৃষ্ঠা ছেঁড়ার উৎসবে মেতে উঠবে।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ পরিনত হতে পারে বই ছেঁড়ার উৎসবের কেন্দ্রে। যা আমাদের একান্ত কাম্য নয়। তাই তার অবশ্যই বই ছিঁড়ে ফেলার জন্য উপযুক্ত সাজা হওয়া উচিৎ নচেৎ দেশে আইনের শাসন তার ভারসাম্য হারাবে। অন্যরা যে কোন সময় যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বই ছিঁড়ে ফেলতে কোন রকম দ্বিধা করবে না।
তিনি শুধু বই ছিঁড়ে ফেলেন নি তিনি একটি মানুষের শ্রেণিকে ছিঁড়ে ফেলেছেন। তিনি একটি মতামত ছিঁড়ে ফেলেছেন। সমাজ থেকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরই ছিঁড়ে ফেলেছেন। তিনি ছিঁড়ে ফেলেছেন রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত একটি মানবিক পদক্ষেপকে যা রাষ্ট্র অনেক সময় ব্যাপি সংগ্রামের মাধ্যমে তা দাঁড় করানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। আর সেটা নিয়ে ঐ শিক্ষক তা অপচিন্তার ব্যাখ্যায় দাডঁ করেছেন নানান অপ ব্যাখ্যা, মিথ্যা বানোয়াট গল্প।
আমাদের অঞ্চলে এমন অনেক মানুষকে আমি দেখেছি যারা আলোচনায় থাকার জন্য বা একটা গোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য এমন কিছু পন্থা অবলম্বন করে যা সমাজে সামপ্রদায়িক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। যারা অশান্ত করতে চায় সমাজের শান্তির নিঃশ্বাস।
এখন দেখা যাক যে ঐ শিক্ষক শরিফার গল্পের যে পৃষ্ঠা ছিঁড়েছেন এবং ঐ পৃষ্ঠায় সমকামী হওয়ার ব্যাপারে নাকি উৎসাহিত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।
শরিফার গল্পে আসলে কি আছে অনেকে সেটা না জেনেই অনেকে ঐ শিক্ষকের ভুল ব্যাখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বইয়ের পৃষ্ঠা ছেঁড়ার মিছিলে।
শরিফার গল্পকে সংক্ষেপণ করলে যেটা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, একটা মানুষ জন্মের পর ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে বড় হওয়ার সাথে সাথে শারীরিক ভাবে সে ছেলের অবয়ব হয়েও মানসিক ভাবে সে যে মেয়ে সেটা সে বুঝতে পারছে। তার আচার আচরণ মেয়েদের মত তার সাজতে মেয়েদের পোশাক পড়তে ভালো লাগে। এক পর্যায়ে সে তার মত আরো একজন পায় যে কিনা প্রাকৃতিক ভাবে তার মতই। পরবর্তীতে সে তার সাথে এমন একটা জায়গায় যায় যেখানে সে তার সমজাতীয় সমমনা সকল কে খুঁজে পায়। যেটা তাদের পৃথিবী এবং ঐ পৃথিবীর দ্বায়িত্বে থাকে একজন গুরু মা যে কিনা তাদের দেখে শুনে রাখে। সর্বশেষ শরিফা এই সমাজের কাছে স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য একটু সুযোগ একটু সহানুভূতি চায় যা তাকে ভালো ভাবে বাঁচতে সাহায্য করবে।
সর্বোপরি এই হচ্ছে শরিফা গল্পের মূল উপজীব্য। যেখানে একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের গল্প বলা হয়েছে। যে কিনা অন্য সবার মতই আমাদের সমাজ এবং আমাদেরই একজন।
আমরা যদি দেখি গল্পটা কাদের জন্য এবং কোন শ্রেণির পাঠ্য করা হয়েছে তা দেখি তাহলে দেখবো সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্য হিসেবে গল্পটা দেওয়া হয়েছে। আমাদের আগামী প্রজন্মের সন্তানেরা যাতে মানবিক বোধে উজ্জীবিত হয়ে গড়ে ওঠে সেই কল্পেই তাদের জন্য এমন মানবিক একটি গল্প প্রস্তুত করা হয়েছে যা আসলে কোন গল্প নয় আমাদের সমাজেরই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। যেখানে ছাই ঢেলে দিয়েছেন ঐ শিক্ষক। এমন নিচু মানসিকতার একজন মানুষ কি করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে যে কিনা একটা শিক্ষার্থী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। এমন একজন শিক্ষকের কাছ থেকে তাহলে এতদিন কি শিক্ষা পেয়েছেন তার শিক্ষার্থীরা ভাবতে পারেন। একজন মানুষ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে আমাদের সমাজে জন্ম নিয়েছেন যা কিনা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণে যেখানে মানুষ, সমাজ, বা ব্যক্তি নিজের কোন হাত নেই। যেখানে আমি অথবা আপনিও এমন হয়ে জন্ম নিতে পারতাম কারণ এটা সম্পূর্ণই প্রাকৃতিক বিষয়। সে প্রাকৃতিক বিষয়টিকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন তার নিজের নিচু মানসিকতা দিয়ে।
সমাজে সকল মানুষ যেন সম অধিকারে বাঁচতে পারে। মানুষের দ্বারা যেন তারা তুচ্ছ বা অপমানের স্বীকার না হয় তাদেরকে যেন আমরা বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে একটু মমতার হাত বাড়িয়ে দেই স্রেফ এই গল্পে এই কথাটাই প্রকাশ পেয়েছে এর বাইরে অন্য কিছু নয়। অথচ ঐ শিক্ষক এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাঠ্য বই থেকে সকলের সম্মুখে ছিঁড়ে ফেললেন। এবং সবাইকে বইটি ছিঁড়ে ফেলার জন্য উৎসাহিত করলেন। এটা কোন সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তার মানুষের কাজ হতে পারে কখনোই নয়। হয় সে বদ্ধ উন্মাদ বা না হয় বিশেষ কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করাই তার মূল উদ্দেশ্য। যা কিনা রাষ্ট্র দ্রোহিতার সমান অপরাধ।
দীর্ঘ সময় মানুষের একটি বিশেষ শ্রেণী অবহেলা নির্যাতনের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত করার পর রাষ্ট্র যেখানে তাদের অধিকার ও স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার কথা বলছে। তাদের প্রতি মানবিক আচরণের কথা বলছে ঠিক তখনই ঐ শিক্ষক ছিঁড়ে ফেলেছেন ঐ রাষ্ট্রের নির্মিত মানবিক ও অধিকারের পাতা। যা কোন ভাবেই অবহেলা করে দেখার সুযোগ নেই।
একটি সমাজ সভ্য এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে সমাজে বিরাজমান মানবিকতা। মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা। মানবিক বোধহীন সমাজ হচ্ছে পশুর সমাজ যা শুধুমাত্র ইতর শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে।
ঐ শিক্ষক আরো কিছু বিষয়ে কথা বলেছেন আর সেটা হচ্ছে এই গল্প আমাদেরকে সমকামী হওয়ার ব্যাপারে নাকি উৎসাহিত করে। আরো বলেছেন ইউরোপ আমেরিকায় নাকি সমকামী না হলে পড়াশোনা ও চাকুরী কোনটাই হয়না। এমন মিথ্যা রটনা বা ভুল ব্যাখ্যা মানুষ তখনই দিতে পারে যখন তার কোন বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। যখন সে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য রপ্ত করতে চায় সমাজের মাথায় কাঠাল ভেঙে। সাধারণ মানুষদের মানসিক ভাবে অপব্যাখ্যা নামক উত্তেজক বড়ি খাইয়ে। সাধারণ মানুষকে বন্দী করতে চায় তার দুষ্ট চিন্তার কারাগারে।
কারো কোন বিষয় পছন্দ না হলে বা কোন বিষয় যদি দৃষ্টিকটু মনে হয় তাহলে সেই বিষয়ে সমালোচনা বা সংগ্রাম যেন একটা গঠন মূলক পদ্ধতির ভেতর দিয়ে হয় সেটা অবশ্যই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। কোন উস্কে দেওয়া মানসিকতা অবশ্যই আমাদের জন্য মাদকের মতই ক্ষতিকর।
তাই আমাদের অবশ্যই এমন অপব্যাখ্যা প্রদানকারীদের থেকে সাবধান থাকতে হবে যাতে তারা চাইলেই আমাদেরকে তাদের হাতিয়ারে পরিণত করতে না পারে। আমরা যেন যে কোন বিশেষ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আমাদের বিবেকের দ্বারস্থ হয়ে সিদ্ধান্ত নিই কোন চাপিয়ে দেওয়া অন্ধ মতবাদে নয়।
কাজী বনফুল, লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক/