জুনায়েদ মাসুদঃ ইতিহাসের বিভিন্ন নিদর্শনে ঘেরা সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলো ঘুড়ে দেখার শখ আমার ছোটবেলা থেকেই। তাই, সময় পেলেই চেষ্টা থাকে গ্রন্থাগার, জাদুঘর বা ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখার।
এবারেও ব্যাতিক্রম হয়নি। ঈদুল আজহার ছুটিতে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম ভাষা শহীদ রফিকউদ্দীন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনে।
ঢাকার মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের পারিলে অবস্থিত এই গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি। ভাষাশহীদ রফিকের স্মৃতিকে ধরে রাখতে ২০০৮ সালে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তার নিজ জন্মভূমি রফিকনগর এলাকায় এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
আমার গ্রামের বাড়ি থেকে ঘন্টাখানেক সময়ের দূরত্ব। অটো বা সি এন জি করেই চলে যাওয়া যায় খুব সহজে। বছরের বেশির ভাগ সময়টা ঢাকায় ব্যাস্ততার মধ্যে কাটে। তাই, দূরত্ব অল্প হলেও যাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠেনা।
শেষবার যখন গিয়েছিলাম তখন আমি মাধ্যমিকের ছাত্র। আর এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে এসে পৌছেছি।
পরিদর্শনে গিয়ে সবচেয়ে বেশি যটি আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হলো; জাদুঘর এলাকার পরিবেশ। মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ আর গাছগাছালির ঘেরা জাদুঘরটি।
যে সুন্দর কংক্রিটের রস্তাটি ধরে জাদুঘরে যেতে হয় তার দুপাশে সারি সারি বটবৃক্ষে ঘেরা। পুরো রাস্তা ছায়ায় দিয়ে রাখে। সাথে ভেসে আসা পূবালী মৃদু বাতাস। অন্যরকম এক অনুভূতি।
জাদুঘরটি এক বিঘা জমিতে একটি বড় দালান আকার নির্মাণ করা হয়েছে। চমৎকার তার নকশা। দেখেই পরিদর্শকরা ছবি তুলতে ব্যাস্ত হয়ে পরে।
বড় ফটক পেরোলে দুপাশে সুন্দর খোলা জায়গা সেখানে ছোট পরিসরে ফুলের বাগান করা হয়েছে।
গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর ভবনে প্রবেশপথে চোখে পরে ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিনের বিশাল পাথর চিত্র। নিচে তার নাম, জন্ম ও শহিদ হবার তারিখ উল্লেখ রয়েছে। তার নাম: রফিকউদ্দিন আহমদ জন্ম: ৩০ অক্টোবর, ১৯২৬ খ্রি: অত্র এলাকাতে এবং তিনি শহিদ হন ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ খ্রি:।
ভেতরে প্রবেশ করলে চোখে পরে চারপাশের দেয়ালে ঝুলন্ত অবস্থায় অনেক বিখ্যাত স্থানীয় মানুষের পরিচয় বর্ণনাসহ ছবি যারা ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখেন। আর বাম পাশের কর্নারে দর্শনার্থীদের পরিদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিনের ব্যাবহৃত জিনিসপত্র যেমন টেবিল, চেয়ার, নকশিকাঁথার রুমাল, চশমা, কলম, জামা ইত্যাদি।
ভেতরে আরো রয়েছে চারপাশ ঘিরে বড় বড় বুকসেল্ফ এবং সেগুলো ভরতি অসংখ্য বই। জাদুঘর পরিচায়কের ভাষ্যমতে, “আনুমানিক ১২ হাজারের মতো বই রয়েছে গ্রন্থাগারে” এই বইগুলোর বেশিরভাগই মূলত ভাষা আন্দোলনের ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক। তাছাড়া, বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যিকদের বইও সেখানে স্থান পেয়েছে।
আমার ব্যাক্তিগত ভাবে ইতিহাস নিয়ে পড়তে জানতে এবং গবেষণা খুব ভালো লাগে। সে সুবাদে কিছু বই পড়ি যার মধ্যে ভালো লেগেছে আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন সম্পাদিত “ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস” বইটি পড়ে। সেখানে আমি ভাষা আন্দোলনে আমার নিজ জেলা মানিকগঞ্জের অবদান ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি। আরো পড়েছি “ড. লুৎফর রহমানের রচনাবলি”, ড. রঙ্গলাল সেনের “সিভিল সোসাইটি”, আল মাহমুদের লিখা ” সাহসের সমাচার”, আরো পড়েছি স্থানীয় লেখকের ” আঞ্চলিক হাস্যরসের গল্প”র বইটি যেটিতে মজার মজার গ্রাম্য কাহিনি ছিলো।
বসে বই পড়ার জন্য জাদুঘরের ভেতরে রয়েছে রিডিং টেবিল এবং অসংখ্য চেয়ার। পাশাপাশি পাঠকদের সুবিধার্থে রাথা হয়েছে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সংযোগ ওয়াই-ফাই। যাতে তারা কোনো বিষয়ে জাদুঘরে তথ্য খুজে না পেলে অথবা বুঝতে অসুবিধা হলে যেনো তাৎক্ষণিকভাবে খুজে নিতে পারেন।
আমি জাদুঘরে প্রবেশ করি বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে এবং বের হই বিকেল চারটার দিকে। পুরোটা সময় বই পড়ে কাটিয়েছি। খুব ভালো লাগছিলো। অমন পরিবেশ কারইনা ভালো লাগে।
জাদুঘরের বামপাশে একটু ভেতরে রয়েছ একটি বড় স্টোররুম। এবং ভবনের একপাশে রয়েছে ওয়েটিংরুম এবং অন্যপাশে রয়েছে শৌচাগার। আর এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য লোক রয়েছেন। যারা নিয়মিত যাদুঘরের দেখাশোনা করছেন।
জাদুঘর পরিচায়কদের সাথে কথা বলে জানতে পারি, বিভিন্ন উৎসবগুলোতে জাদুঘরে মানুষের উপচে পড়া ভীড় থাকলেও অন্যান্য সময়ে দর্শনার্থী খুব কমই পরিদর্শনে আসেন। জাদুঘর ফাকা থাকে বললেই চলে। মাঝে মাঝে দু-চারজন আসলেও তারা ইতিহাস জানার জন্য আসেন না। ছবি তুলতে ব্যাস্ত থাকেন, বইও তেমন পড়েননা।
খুবই দুঃখজনক, আমরা গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরকে মূল্যায়ন করতে পারছিনা। সরকার আমাদের এতো সহজে ইতিহাস জানার, দেখার সুযোগ করে দেয়া সত্বেও আমাদের মধ্যে আগ্রহটা তৈরি হচ্ছেনা।
আমরা আসলে জানিনা “জাদুঘর” আদৌও কি?
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ভাষায়, জাদুঘর হলো আত্মপরিচয় লাভের ক্ষেত্র। তিনি তার “জাদুঘরে কেন যাবো” প্রবন্ধে লিখেছেন, “জাদুঘর আমাদের জ্ঞান দান করে আমাদের শক্তি জোগায়, আমাদের চেতনা জাগ্রত করে আমাদের মনোজগৎকে সমৃদ্ধ করে। জাদুঘর একটা শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন। সমাজের এক স্তরে সঞ্চিত জ্ঞান তা ছড়িয়ে দেয় জনসমাজের সাধারণ স্তরে। গণতন্ত্রায়ণের পথও প্রশস্ত হয় এভাবে। জাদুঘর শুধু জ্ঞানই ছড়িয়ে দেয় না, অলক্ষে ছড়িয়ে দেয় ভাবাদর্শ।”
মজার বিষয় হলো, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নিজেই এই গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটির উদ্বোধন করেন।
পরিশেষে বলতে চাই, ইতিহাস অনুরাগী একজন মানুষ হিসেবে গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটি ভ্রমণ আমাকে অনেক বেশি আনন্দিত করেছে। বলা হয়, যে জাতি তার ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত, সে জাতি তার দ্বায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে সচেতন। তাই, এ সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে চেষ্টা চলবে নিরন্তর।
-শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।