The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪

প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব

নৈতিকতা শব্দের অর্থ হলো ভদ্রতা, চরিত্র, উত্তম আচরণ। এটি মূলত উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত এবং কর্মের মধ্যকার ভালো-খারাপ, উচিত-অনুচিত এর পার্থক্যকারী।

অপরদিকে মূল্যবোধ কথার অর্থ হচ্ছে মূল্যবান, মর্যাদাবান বা শক্তিশালী হওয়া। ব্যক্তির জানা, পরিচিত বা নিজের আয়ত্তে যা কিছু আছে, তার চেয়েও অধিকতর মূল্যবান,যা কিছু সঞ্চয় করে রাখার মতো তা হলো মূল্যবোধ। মানুষের আচরণ পরিচালনাকারী নীতি ও মানদণ্ডকে মূল্যবোধ বলে।

মূল্যবোধ একটি মানবিক গুণ, এটি মানবিক গুনাবলির সব থেকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। এই গুণের ভিত্তিতে আমরা মানুষ হিসেবে চরিত্রবান হয়ে থাকি।

কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর বলেছেন-

ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হস্তে বাড়ে,

দোসর জনম দিল তিহ সে আহ্মার।

পিতা-মাতা সন্তানকে জন্ম দেন সত্যি, কিন্তু সন্তানকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলেন শিক্ষকরা। তাই কবি সগীর শিক্ষকদের দোসর জনমদাতা বলেছেন।সন্তানের এই সফল জীবনগঠনে এবং নীতি ও নৈতিকতার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে মা-বাবার স্বপ্নপূরণকারী হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়।

প্রশ্ন আসতে পারে- পৃথিবীতে এত বিদ্যালয় থাকতে সন্তানের সফল জীবন গঠনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন? এর প্রথম উত্তর হলোঃ এ বিদ্যালয় হলো সন্তানের শৈশবের বিদ্যালয়। সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনের বুনিয়াদ বা ভিত্তি স্থাপিত হয় এই শৈশব বা বাল্যজীবনেই। তখন ওদের হৃদয়টা থাকে নরম কাদার মতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে ধাঁচেই তাদের গড়ে তুলবে, ঠিক সে ধাঁচেই তাদের চিন্তা, চেতনা, মেধা ও চরিত্র বিকশিত হবে। পরবর্তী বিদ্যালয়ে কেবল এই ভিত্তিটাকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করা হয়।

তাই বলা যায়, পিতা-মাতার পক্ষ থেকে তাদের ঐকান্তিক সহযোগী হিসেবে সন্তানের শৈশবটাকে সফল ও উন্নত জীবনের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকরা।

সন্তানের জীবনটাকে সফল ও সার্থক করতে হলে শিক্ষককে যেসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হয় সেগুলো হলো- তাদের মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও প্রতিভার বিকাশ, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ, সময়ানুবর্তিতা শিষ্ঠাচার, সামাজিকতা ও দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পরায়ণতা এবং শৃঙ্খল। এসব গুণ ও যোগ্যতা যদি কোনো সন্তানের শৈশবে গড়ে না ওঠা, তাহলে পরবর্তী বিদ্যালয়সমূহে তাকে সুপথে পরিচালিত করা ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রবাদ আছেঃ কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাস ঠাস। তাই সন্তানকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সফল ও মহৎ জীবনের ভিত্তি নির্মাতা হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

আমরা জানি, শৃঙ্খলাই হলো শৃঙ্খলমুক্তির একমাত্র পথ। যার জীবনে শৃঙ্খলা নেই, তার জীবনে কখনো কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসে না। অন্যদিকে, চরিত্র মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ ও মানব জীবনের মুকুট স্বরূপ। যার চরিত্র নেই, তার কোনো যোগ্যতাই নেই। তাই শৃঙ্খলার অভ্যাস যেমন শৈশব থেকে গড়ে তুলতে হবে,তেমনি শৈশব থেকেই সন্তানের উত্তম চরিত্র গঠন করতে হবে। দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য, তাই সন্তানের শ্রেণি ও বয়স উপযোগী লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের সচ্চরিত্র গঠন করতে হবে। বড়কে সম্মান ও ছোটকে স্নেহ করার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তাকে এভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন সে পিতা-মাতা ও শিক্ষক-শিক্ষিকাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে এবং সবার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করে।

ইতিহাসের বিখ্যাত মনীষীগণের সফল জীবন বিনির্মাণে নৈতিক শিক্ষায় বিশাল ও অনন্য অবদান রেখেছিল। শৈশবে যে নৈতিকতার বাণী তারা আত্মস্থ করেছিলেন তা তাদের মনে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছিল। এই নীতিবোধের ফলে তারা প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাই নিঃসন্দেহে সন্তানের নৈতিকতা শিক্ষায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

এটা সর্বজন বিদিত যে, শিক্ষকদের ভালো কথা, উপদেশ ও পরামর্শ শিক্ষার্থীদের মনে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে বিভিন্ন ভাবে প্রয়াস চালাতে পারেন এবং শ্রেণিতে পাঠদানের পাশাপাশি নৈতিকতা শিক্ষার ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারেন। প্রতিদিন পাঠদানের শুরুতে বা শেষে নৈতিকতা চর্চার ব্যাপারে উপদেশ দিতে পারেন। নীতিকথা নিয়ে অনেক গল্প আছে, তারা শিক্ষার্থীদের সেগুলো শোনাতে পারেন। শিক্ষার্থীরা এসব গল্পে উজ্জীবিত হতে পারে এবং নীতিকথাগুলো তাদের মনের গভীরে শিকড় গাড়তে পারে।

দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে গড়ে তুলতে হবে। সদা সত্য কথা বলার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। ভালো কাজ করা এবং অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের উপদেশ দিতে হবে। নিয়মিত অ্যাসেম্বলিতে কোনো না কোনো নৈতিক বাক্য নিয়ে দুই-তিন মিনিট আলোচনা করতে হবে। ভালো গুণ ও সদ্ব্যবহার শিক্ষার্থীদের অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে রাখে, তাই প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে ভালো কাজ করার ব্যাপারে তাদের উৎসাহ দিতে হবে। নেতিবাচক মানসিকতা ও চিন্তা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতে হবে। দুর্নীতি, মাদকাসক্তি, পরীক্ষায় নকল প্রবণতা ইত্যাদি খারাপ কাজে যাতে কেউ জড়িত না হয় সে ব্যাপারে তাদের সচেতন করতে হবে। মন্দ কাজের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে তাদের বুঝিয়ে সতর্ক করতে হবে।

বর্তমানে সারা দেশে মূল্যবোধের অবক্ষয় ধুঁকছে, নৈতিক শিক্ষার প্রকট অভাবে ভুকছে জাতি। সমাজের ছোটরা আজকাল বড়দের স্মমান করে না, গুরুজনদের দেখে উঠে দাঁড়ায় না ও সালাম দেয় না। পাবলিক বাসগুলোতে যাতায়াতের সময় বয়স্ক গুরুজনদের দেখে এখন আর কম বয়সিরা আসন ছেড়ে দাঁড়ায় না, এমন কি অনেক সময় ছাত্র-ছাত্রী বা তাদের সমবয়স্ক লোক বয়স্ক লোকদের ধাক্কা কিংবা ঠ্যালা দিয়ে বাসের আসন দখল করে বসে।

এভাবে নৈতিকতার অবক্ষয় হতে থাকলে সভ্যতা ও সংস্কৃতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা প্রবল উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিশুর সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করার পাশাপাশি তাদের নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটিয়ে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃত মানুষরাই তো দেশের সুনাগরিক ও জনসম্পদ। প্রাথমিকের গন্ডিতে শিশুদের সচ্চরিত্রবান ও নৈতিকতাবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পিতা-মাতার পরেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুতবপূর্ণ।

লেখক: মোঃ কামরুল হাসান সোহেল, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, নবাবগঞ্জ, ঢাকা

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.