কাজী বনফুলঃ সম্প্রতি নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে কিছু ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সেই ভিডিও গুলো ফেসবুকে শেয়ার করে ট্রল করছে আমাদের ফেসবুক প্রজন্ম আর সেই ট্রলে মেতে উঠছে সমগ্র বার্ধক্যে মোরানো মানুষ। এই ফেসবুকে ট্রল করার অন্যতম কারণ হচ্ছে ভিডিও গুলোতে শিক্ষকরা কেন শিশুদের মত আচরণ করছে। তারা একদমই ভুলে গেছে যে আসলে যে শিক্ষকরা ভিডিও গুলোতে বাচ্চাদের মত আচরণ করছে এবং প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তারা বাচ্চাদেরই শিক্ষক কোন বার্ধক্যে জর্জরিত বৃদ্ধদের শিক্ষক নন।
আমরা কোন কিছু গভীরে গিয়ে উপলব্ধি না করেই নিজের ভাসা ভাসা বিবেচনা দিয়ে বিচার করেই রায় দিয়ে থাকি সবকিছুর।
ফেসবুকে পেলাম আর শেয়ার করে দিয়ে হাসাহাসি করলাম এটা কোন সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজের আচরণ হতে পারে না। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ সে বিষয়ে অবশ্যই আলোচনা সমালোচনা থাকবে বা হতে হবে কিন্তু সেটা হতে হবে যুক্তিনির্ভর ও গঠনমূলক। এ সকল সিলি বিষয় নিয়ে মেতে থাকলে তাৎপর্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবার সময় কই আমাদের? কথা বলতে হবে প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে যা একান্ত প্রয়োজন।
বিশ্বের অনান্য দেশে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক হয় সমবয়সী বন্ধুর মত আর আমাদের অঞ্চলের শিক্ষকরা ছাত্রদের সাথে একজন প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়। শিশুদের সাথে শিশু হয়ে ওঠা শিক্ষক বা গুরুর সন্ধান আমার চোখে খুব একটা পড়ে নি। সবাইকে দেখিছি শিশুদের ভয়ের কারণ হয়ে উঠতে। ভয় সব সময়ই সৃষ্টিশীলতার বিপরীতে অবস্থান করে। জীবনের শুরুতে যে শিশু ভয় দিয়ে তার জীবন যাত্রা শুরু করে তার থেকে উত্তম কিছু প্রত্যাশা করা বোকামি।
একজন শিশুকে শিক্ষা দানের জন্য একজন শিক্ষকের সর্বপ্রথম শিশুের মত সরল ও প্রাণবন্ত হবে। শিশুদের মনস্তত্ত্বকে গভীর ভাবে বুঝতে হবে। আর শিশুদের মত না হওয়া পর্যন্ত একজন শিক্ষক কখনোই শিশুদের শিক্ষক হয়ে উঠতে পারবে না। সে শিক্ষক হয়ে উঠবে শুধুমাত্র বার্ধক্যর শিক্ষক।
যে কোন বিষয়ে নতুনত্বকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে ব্যাপক অনীহা। কারণ আমরা নতুন কে সব সময় ভয় পাই আমরা আমাদের চলমান কমফোর্ট জোনকে কোন ভাবেই পরিত্যাগ করতে চাই না। বিশ্ব যেখানে নতুন প্রাণ সমৃদ্ধ গ্রহের সন্ধানে ব্যাস্ত সেখানে আমরা ডুবে থাকতে চাই সেই পুরনো বেলুনে। আমরা নিজেরা যেমন হাসতে বা আনন্দ করতে জানি না তেমনি কাউকে আনন্দ বা হাসতে দেখলেও আমরা সহ্য করতে পারি না। আমাদের শিক্ষকদের বাচ্চাদের মত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে আর তা দেখেই সবাই এক হয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে ফেসবুক কমেন্ট বক্সের উপর। শিক্ষা ব্যবস্থার মূল সমস্যা নিয়ে কথা না বলে বলছে অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে। যে প্রশিক্ষণ শিক্ষকদের দেওয়া হচ্ছে সেটা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অবশ্যই ভালো।
এক জরিপে দেখলাম বাংলাদেশের শিশুরা সবচেয়ে কম শারীরিক এক্টিভিটির সাথে সম্পৃক্ত। স্কুলে শুধুমাত্র বর্ণ মুখস্থের বাইরে তাদের আর কোন শারীরিক এক্টিভিটি বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর কোন এক্টিভিটি নেই। যেখানে জাপান, চায়না ও অনান্য উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শারীরিক কারিকুলাম, কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আমরা তাদের তুলনায় পড়ে আছি আদিম বর্ণ মুখস্থ প্রথায়।
নতুন শিক্ষা কারিকুলামে সম্ভবত এই বিষয় গুলোর উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে যেন শিক্ষকরা এটা ভুলে না যান যে তারা শিশুদের শিক্ষক তারা কোন বৃদ্ধ মানুষের শিক্ষক নন। যেহেতু তারা বৃদ্ধদের শিক্ষক নয় তাই তাদেরকে শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আর সেই ভিডিও গুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের অঞ্চলের ফেসবুক বোদ্ধারা প্রমাণ করছে যে শিশুদের সাথে বৃদ্ধদের মত আচরণ করতে হবে শিশুদের মত নয়।
পৃথিবীর সকল দেশ যেখানে কর্মমুখী ও শারীরিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রসর সেখানে আমাদের পিছিয়ে থাকার কোন সুযোগ নেই। যাদের নতুনত্বকে মানতে কষ্ট হয় তারা প্রবীণ বৃদ্ধ মানুষ। আর এই বার্ধক্য থেকে আমাদের বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত আমাদের আলো দেখার সুযোগ নেই।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি -বিচুতি রয়েছে। যা বর্তমান বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাদের বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। আমাদের আরো বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। শিক্ষকরা সেই আদি কায়দায় ই বাচ্চাদের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে কোন নতুনত্ব নেই কোন ভ্যারিয়েশন নেই। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নতুনত্ব আনতে হবে শিক্ষা পদ্ধতিতে।
শুধুমাত্র সার্টিফিকেট নামক কাগজ অর্জন ভিত্তিক শিক্ষা দিয়ে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে টিকে থাকাটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়বে তার জন্য চাই কর্মমুখী, বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত শিক্ষা ব্যবস্থা।
সে জন্য শিক্ষকদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ সহ বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও তাদের এই সকল বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। যাতে তারা বাচ্চাদের এ সকল বিষয়ে সঠিকভাবে শিক্ষা প্রদান করে ভবিষ্যৎ এর জন্য গড়ে তুলতে পারে। অভিভাবক যারা আছেন তাদের ও আরো বেশি সচেতন হতে হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবী সম্পর্কে। শুধুমাত্র স্কুলের উপর সকল দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা মুখ ঢেকে বসে থাকলে হবে না। মনে রাখতে হবে একটি শিশুর প্রথম স্কুল তার পরিবার এবং মা-বাবা হয়ে থাকে।
এক গবেষণায় দেখলাম উন্নত দেশ গুলোতে বাচ্চাদের উপর নানা ধরনের গবেষণা চালিয়ে তাদের মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও চাওয়া পাওয়ার উপরে তাদের পাঠ্যসূচি নির্মিত হয় যা ইচ্ছে তাই চাপিয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ নেই সেখানে। কারণ তারা এটা খুব ভালোভাবেই জানে যে এই শিশুরাই বড় হয়ে দেশের ভার তাদের কাধে তুলে নিবে। তাই যাচ্ছেতাই তাদের পড়া আকারে খায়ানোর কোন সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে আমাদেরও এমন পাঠ্যসূচি তৈরি করা উচিৎ যেটা আমাদের শিশুদের প্রয়োজন। আর এসকল বিষয় আমাদের পাঠ্যসূচি নির্মাতাদের অবশ্যই মাথায় রেখে পাঠ্যসূচি তৈরি করতে হবে।
তাই সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা পেতে পারি একটি ভালো ও মান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা যা আমাদেরকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।
কাজী বনফুল, লেখক ও কলামিস্ট/