সারওয়ার মাহমুদ, চবিঃ
“তুমি আজীবন বেঁচে থাকো আন্দোলন সংগ্রামের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে।
তুমি বেঁচে থাকো জ্ঞানপিপাসুদের আশ্রয়স্থল হয়ে।
তুমি বেঁচে থাকো হার না মানা অসংখ্য প্রেমকাব্যের স্বাক্ষ্য হয়ে।
তুমি বেঁচে থাকো সবুজ ঘাসের স্নিগ্ধতায় আর অন্যায়ের প্রতিবাদের ঢাল হয়ে।
তুমি বেচেঁ থাকো আরো এক কোটি বছর “
আজ ১৮ নভেম্বর চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ৫৭ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে এমন অনুভুতি প্রকাশ করেছেন এক শিক্ষার্থী।
১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চারটি বিভাগ নিয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিম-পট্টি মৌজার ২১০০ একর জায়গাজুড়ে পাহাড়ের কোল ঘেষে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক দিয়ে এটি তৃতীয় বৃহত্তম এবং আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় এটি।বর্তমানে ১০টি অনুষদ ও ২টি ইনস্টিটিউটের আওতাধীন ৫৪টি বিভাগে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে আছেন প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী।
যেখানে সকাল হয় শাটলের হুইসেলে ,পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয় সবুজ প্রকৃতি।বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে ওঠে কাটাপাহাড়ের রাস্তা। ভিড় জমতে থাকে ঝুপড়িগুলোয়।
প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত চবি’র পুরো আঙিনা দেখতে অপরূপ। দৃষ্টিজুড়ে নান্দনিক, অপ্সরী। নান্দনিক সৌন্দর্যের পুরোধা।সৌন্দর্যপিপাসুদের কাছে পরম আকর্ষণীয়। ভ্রমণের পিপাসা মেটায় চিরসবুজ-শ্যামল এই সোনালি ক্যাম্পাস।প্রতিষ্ঠার ৫৬ বছর পরেও যে বৈশিষ্টগুলোর জন্য চবি চির যৌবনা সেগুলোর মধ্য উল্লেখযোগ্য হলো:
১.প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিঃ
কবি সত্যিই বলেছেন, আমাদের দেশ পৃথিবীর সৌন্দর্যের রাণী। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন, ঐতিহাসিক স্থাপনা, বিস্তীর্ণ পাহাড় রাশি, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, অফুরন্ত সবুজের সমারোহ সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হিসেবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
শহরের কোলাহল আর যান্ত্রিকতা থেকে দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন প্রকৃতি আর মানব প্রাণের মিলনস্থল। সবুজ বৃক্ষসারির উপর উড়ন্ত বিচিত্র রঙের হরেক রকম পাখি, প্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়, বাণিজ্য অনুষদের পেছনে, ফরেস্ট্রি একালাসহ অন্যান্য সবুজ পাহাড়ের কোলে প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা ছোট আকারের লালচে বাদামী পিঙ্গল রংয়ের মায়া হরিণ, অজগর কিংবা বিচিত্র রকমের দুর্লভ প্রাণীর জীবন্ত জাদুঘর চবি ক্যাম্পাস। ঝুলন্ত সেতু, ঝর্ণাধারা, উদ্ভিদ উদ্যান কিংবা সুবিশাল মাঠ কি নেই চবি ক্যাম্পাসে! পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিরিপথের দেখা পাওয়া যায় কিনা সেই সন্ধান দিতে পারবেন কি? চবিতে এসে দলবেঁধে ভ্রমণ করতে পারেন অপরূপ সৌন্দর্যের চালন্দা গিরিপথ যা আপনাকে এডভ্যাঞ্জারের পাশাপাশি অতিমাত্রায় বিমোহিত করবে
প্রকৃতি প্রেমীরা এখানে নিজেকে খুঁজে পাবেন সবুজের পাতায় পাতায়, দূর পাহাড়ে শেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মাঝে কিংবা শীতের সকালের শিশির বিন্দুতে, প্রকৃতির নির্জনতায় আর রাতের নিস্তব্ধতায়।
আর যারা চট্টগ্রামের বাইরে থেকে আসবেন তারা খুব সহজেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ফাঁকে ফাঁকে চাইলে দেখে নিতে পারেন কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি আর খাগড়াছড়ির বৈচিত্রময় প্রকৃতি আর পাহাড়ি জনপদের জীবনযাত্রা। ক্লাসের বাইরের এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আপনাকে নির্মল বিনোদনের পাশাপাশি আত্ববিশ্বাস আর কর্মতৎপরতা বাড়াতেও সহায়তা করবে।প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারা, উদ্ভিদ উদ্যান আর মায়া হরিণের দেখা পাবেন চবিতে।
২। বিশ্বের একমাত্র শাটল ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
চবি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে এখনো শাটল ট্রেন এখনো চলাচল করে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ বলা হয় এই শাটল ট্রেনকে। এই শাটলেই প্রতিদিন হাজারো প্রাণের মেলা বসে। গল্প আড্ডা আর গানে মুখরিত হয়ে উঠে এই শাটল ট্রেন। এই ট্রেনের বগিতে গান করে অনেকেই হয়েছে বিখ্যাত গায়ক। তাই চবিকে গানবাজদের তীর্থস্থানও বলা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যয়ন শেষে এখানকার শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশী যা মিস করে তা হলো এই শাটলের আড্ডা আর গান।
৩। অসাধারণ ফ্যাকাল্টিঃ
বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ সর্বজন শ্রদ্ধেয় ডঃ জামাল নজরুল ইসলাম স্যার , নোবেল বিজয়ী ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস স্যার , বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল মান্নান স্যারের মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা শিক্ষকতা করেছেন চবিতে। পুরাতন ধ্যান- ধারণা ভেঙ্গে গুরু শিষ্য সম্পর্কের গন্ডি পেরিয়ে চবির শিক্ষক, শিক্ষার্থীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক সম্পর্ক যেন জীবনের অন্য রকম অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরা দেয়। এখানে রয়েছে এমফিল, পিএইচডি ,এমডি,এমপিএইচ এর মতো উচ্চতর ডিগ্রী গ্রহনের সুযোগও।
৪। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরঃ
১৯৭৩ সালের ১৪ই জুনে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের একমাত্র অ্যাকাডেমিক জাদুঘর যা মূলত মানব ইতিহাস, শিল্প এবং সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের সহায়তা প্রদান, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস ও প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন এবং এ সকল বিষয়ে মৌলিক গবেষণার সু্যোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। এটি চট্টগ্রামের একমাত্র শিল্প জাদুঘর এবং দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যেও একমাত্র জাদুঘর হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঠক্রমের সমর্থনে রয়েছে ‘প্রাণীবিদ্যা জাদুঘর’,আবার বিশ্ববিদ্যালয়েরই সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে গড়ে তোলা হয়েছে ‘সমুদ্র সম্পদ যাদুঘর’ যেখানে ৫৫০টির মতো সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে।
৫। ৪০ হাজার জার্নাল সমৃদ্ধ চবি গ্রন্থাগারঃ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার যা দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই গ্রন্থাগারে বর্তমান সংগ্রহ সংখ্যা প্রায় ৩.৫ লক্ষ যার মধ্যে রয়েছে বিরল বই, জার্নাল, অডিও-ভিজ্যুয়াল উপাদান, পান্ডুলিপি এবং অন্ধদের জন্য ব্রেইল বই। গ্রন্থাগারটিকে বর্তমানে অটোমেশনের আওতায় আনা হয়েছে।
৬। চবির স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্যঃ
বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের সাথে চবির নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথেই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধারদের আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ নির্মিত ‘স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ’ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ছবি রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে “বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ’। স্তম্ভটির অবস্থান বুদ্ধিজীবী চত্বর নামে পরিচিত। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের বিপরীত পাশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবস্থিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে রয়েছে নবনির্মিত ‘স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল’, ভাস্কর্যটিতে ৪টি পাখির প্রতীকী নির্মাণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাঙালির ছয় দফা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রমধারা এবং পাখির ডানায় ২১টি পাথরের টুকরায় লিপিবদ্ধ হয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি।
৭। চবির হলসমূহ – যেন প্রকৃতির সাথে বসবাসঃ
পাহাড় ঘেরা প্রকৃতির কোলে চবি ক্যাম্পাসে রয়েছে ১২টি আবাসিক হল যার মধ্যে ৮টি ছাত্র হল ও ৪টি ছাত্রী হল এবং ২টি নির্মানাধীন ছাত্র ও ছাত্রী হল। । প্রতিটি হলের নির্মাণশৈলী যেমনি আলাদা তেমনি হল গুলো কোনটা পাহাড়ের কুল ঘেষে আবার কোনটা পাহাড় আর নয়নাভিরাম সবুজের ঘেরা যেন এক স্বপ্নপূরী। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দূর পাহাড়ে পাখির কলতান, জোনাকির মৃদু আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পুরো ক্যাম্পাসকে করে তুলে আরো আকর্ষণীয়।
৮। ঝুপড়ির মধুর আড্ডা:
চবির বিভিন্ন অনুষদ ও হলগুলোর পাশে রয়েছে সারি সারি অনেক দোকান। এসব দোকানকে ঝুপড়ি নামে ডাকা হয়। চবি শিক্ষার্থীদের আড্ডার অন্যতম জায়গা এই ঝুপড়িগুলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্বাদু আর রুচিশীল খাবারগুলোর উৎস হলো এসব ঝুপড়ি। হরেকরকম ভর্তা আর নানা মজাদার খাবারের জমজমাট আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষদের সঙ্গে থাকা পাহাড়ের কোলঘেঁষে টিনের ছাউনিতে নির্মিত এই ঝুপড়িগুলো। অপেক্ষাকৃত অল্প দামে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, গরম ভাত কিংবা ভর্তার জন্য অপেক্ষমাণ শত শত শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর এই ঝুপড়িগুলো। যেন ধনী, মধ্যবিত্ত, নিম্ম মধ্যবিত্ত এবং গরিব শিক্ষার্থীদের এক মিলনমেলা। যেখানে সবাই সমান, সহযাত্রী সবাই রাজা, সবাই বাদক, গায়ক কিংবা আড্ডাবাজ। কলা অনুষদের ঝুপড়ি, সমাজ বিজ্ঞানের ঝুপড়ি, লেডিস হলের ঝপড়ি এদের মধ্যে অন্যতম।