The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪

ঢাকা শহর, বর্ষা ও দুর্ভোগ যেন একই সূত্রে গাঁথা

নাইমুর রহমান: ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী ও মহানগর । ইসলাম খানের হাত ধরেই ১৬১০ সালে ঢাকা প্রথম রাজধানীর মর্যাদা পায়। প্রশাসনিকভাবে এটি ঢাকা বিভাগের ও জেলার প্রধান শহর। ভৌগোলিকভাবে এটি বাংলাদেশের মধ্যভাগে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে একটি সমতল অঞ্চলে অবস্থিত। ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ায় মুম্বাইয়ের পরে দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শহর। হাজারো ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক এই ঢাকা শহরে যেমন রয়েছে অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধা তেমনি আছে অসম দুর্ভোগ । প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস এই ঢাকাতে । আবার ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বলা হয় পুরান ঢাকাকে । পুরান ঢাকা মহানগরীর আদি অঞ্চল ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র । বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ বাঙালি সংস্কৃতি থেকে এখানকার সংস্কৃতি অনেকটাই ভিন্নতর। পুরান ঢাকা পূর্ব-পশ্চিমে গেন্ডারিয়া ফরিদাবাদ থেকে হাজারীবাগ ট্যানারি মোড় পর্যন্ত এবং দক্ষিণে ঢাকা সদরঘাট থেকে নবাবপুর পর্যন্ত বিস্তৃত।

ঢাকা শহরে নানাবিধ উন্নয়ন পরিলক্ষিত হলেও কিছু সীমাবদ্ধতা দেখতে পাওয়া যায়। সীমাবদ্ধতা সবসময় দৃশ্যমান না হলেও বর্ষা মৌসুমে এই সীমাবদ্ধতা গুলো চোখে পড়ে। বিপুল লোকের বসবাস হওয়ায় সীমাবদ্ধতা বিরাজ করবে এটাই স্বাভাবিক তবে সমস্যা সমাধানের রাস্তাও নিশ্চয়ই বের করতে হবে । কিন্তু সমস্যা দিন দিন প্রধান সমস্যা হয়ে প্রতীয়মান হয়েছে। বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার বেহাল দশা আগে থেকেই দেখেছে নগরবাসী কিন্তু সম্প্রতিক সময়ে এটি মারাত্মক দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। এই সময়ে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এদেশে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটে, যা নগরীর বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২০৩ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয় যা ঢাকার অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নিকাশী ব্যবস্থার ত্রুটি, এবং জলাধার কমে যাওয়ার কারণে বর্ষাকালে ঢাকার জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকা একটি জনবহুল শহর হলেও এখানে পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। ঢাকার পানি নিষ্কাশন সমস্যা দীর্ঘদিনের। এই পানি সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ –

পুরাণ ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা বহু পুরনো ও অপরিকল্পিত। এই এলাকার ড্রেনেজ সিস্টেম মূলত ব্রিটিশ আমলে বা তার আগেও স্থাপিত হয়েছিল, যা বর্তমান জনসংখ্যা এবং নগরায়ণের চাপে কার্যত অচল হয়ে পরেছে। ঢাকাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক পানি নিষ্কাশন পাম্পের অভাব রয়েছে এটি জলাবদ্ধতার মূল কারণ। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার মূল প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ঢাকা ওয়াসা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন । এই সংস্থাগুলোর অধীনে বিভিন্ন এলাকায় পানি নিষ্কাশন পাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

(২০২০-২০২১ ) সালের নগরায়ণ সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০টি পানি নিষ্কাশন পাম্প আছে, যা মূলত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্ত ঢাকার মত জলমগ্ন এলাকায় সেটি পর্যাপ্ত নয় । ঢাকার কিছু এলাকা আছে যেখানে পাম্পের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। নিম্নাঞ্চল এবং বেশি জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এলাকাগুলো হলো- মিরপুর, বিশেষ করে মিরপুর-১০, ১১, ও ১২ নম্বর এলাকায় বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও বসুন্ধরা, বনানী, গুলশান এলাকা ,বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, গুলশান-বনানী ও পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় পুরোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত এবং অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত। তাই এসব এলাকায়ও পানি নিষ্কাশন পাম্প প্রয়োজন হয় তাই চাঁনখারপুল, নবাবপুর, বংশাল ইত্যাদি এলাকায় পানি নিষ্কাশন পাম্প বেশি স্থাপন করা হয়েছে

বুড়িগাঙ্গা ,তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা ছাড়াও অনেকগুলো খাল রয়েছে ঢাকা শহরে । যা একসময় শহরের পানি নিষ্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করত । এছাড়া, ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী খালের সংখ্যা ৪৭টি। এক সময় ঢাকায় এই ৪৭টি খালই সচল ছিল , যা বৃষ্টির পানি সরিয়ে নিতে সহায়তা করত। যেমন – শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত খাল ছিল, ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে এর নাম পরীবাগ খাল। তবে সেখানে এখন খালের চিহ্ন নেই। ঠিক একইভাবে ধোলাইখাল, রায়েরবাজার, আরামবাগ, গোপীবাগ, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, নারিন্দা, ধানমন্ডি খালের কোনো অস্তিত্বই এখন নেই। রাজধানীর অন্যতম পুরনো খাল আদি বুড়িগঙ্গা। মূলত এটি বুড়িগঙ্গার একটি অংশ, যা বুড়িগঙ্গাকে সংযুক্ত করেছে ধলেশ্বরী ও তুরাগের সঙ্গে। সেই আদি বুড়িগঙ্গা দখল-দূষণে হারিয়ে গেছে। এমন অবস্থা মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকার কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালেরও। শুধু এসব এলাকা নয়, রাজধানী ঢাকার সব খালের চিত্র একইরকম। অনেকগুলো খাল এখন বিলুপ্ত। যেগুলো রয়েছে তার বেশিরভাগই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। আগে খালের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটের বেশি। খালের সঙ্গে নদীর যে যোগাযোগ চলত তা এখন বিচ্ছিন্ন। খালের পানি এখন আর নদীতে প্রবাহিত হয় না। খালগুলো হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জলাবদ্ধতা।

পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত ড্রেনের মধ্যে কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, যা ড্রেনেজ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ৫,০০০-৬,০০০ টন বর্জ উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে কঠিন বর্জ এবং তরল বর্জ উভয়ই রয়েছে। বেশিরভাগ বর্জ আসে গৃহস্থালি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ও শিল্প কারখানা থেকে বিশেষ করে বংশাল, চকবাজার, লালবাগ, শাঁখারীবাজার, এবং ইসলামপুর এলাকা থেকে এবং অধিকাংশ সময়ে তা যত্রতত্র ফেলা হয় । ফলে বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হয়, যা জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ দূষণের সৃষ্টি করে। অধিকন্তু, পুরাতন ড্রেনেজ ব্যবস্থা শহরের দ্রুত বৃদ্ধি এবং আধুনিকায়ণের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারছে না, রাস্তা বা ভবন নির্মাণের সময় সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই নতুন ড্রেনেজ তৈরি করা হয়েছে । সরেজমিন কলতাবাজার, লক্ষিবাজার, কাগজিটোলাতেও একই অবস্থা দেখা যায়

আমাদের দেশে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ঢাকার খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে ঢাকা ওয়াসা। আইন অনুযায়ী সব খালের মালিক জেলা প্রশাসন এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। মোট খাল ৪৭ টি থাকলেও ওয়াসা বলছে, তারা ২৬টা খাল জেলা প্রশাসন থেকে বুঝে নিয়েছে এবং শুধু সেগুলোরই সংস্কার করছে, বাকিগুলোর ব্যাপারে তারা জানে না। তাহলে বাকি ২১টি খাল হারাল কোথায়? এভাবেই বহু বছর ধরে চলছে দখল-দূষণ আর উচ্ছেদের খেলা । ফলে বাকি কাজ নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। আবার , শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা এই চার নদী রক্ষায় ২০০৯ সালে হাইকোর্ট থেকে ১২ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন হওয়ার করার জন্য কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি । এদিকে আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার খালগুলো দখলমুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস কিন্তু সরকার পতনের পরে সেটি আর হয়ে উঠেনি ।

ড্রেনেজ ব্যবস্থার নিয়মিত পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথভাবে হয় না। এ কারণে ড্রেনগুলো অবরুদ্ধ হয়ে থাকে এবং বৃষ্টির সময় সহজেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয় কারণ নগরীর মাটির প্রায় ৮০ ভাগ কংক্রিটে ঢাকা পড়েছে, তাই মাটির পানি শুষে নেওয়ার পথ বন্ধ। পানি সরে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অর্থাৎ নর্দমা ও খাল বেদখল হয়ে গেছে। খালগুলো হয় ভরাট হয়েছে, নয় আবর্জনা-পলিথিনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধ্বংসের পাশাপাশি অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বিভিন্ন সংস্থার সংস্কারকাজের কারণে ম্যানহোলের ঢাকনা নষ্ট হয়ে যাওয়া, বৃষ্টির সময় ঢাকনা না খোলা, অপরিকল্পিতভাবে বক্স কালভার্ট নির্মাণ ইত্যাদি কারণে ঢাকায় বৃষ্টি হলেই মানুষ জলাবদ্ধতা ও তীব্র দুর্ভোগের শিকার হয় । প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য মোট ভূমির ১২ শতাংশ জলাধার প্রয়োজন, কিন্তু ঢাকায় টিকে আছে মাত্র ২ শতাংশ। নগরীর ৫৮টি খালের মধ্যে ৩৭টির অংশবিশেষ রাজউকসহ তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং ২৪৮ জন ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে। (প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। ঢাকা ওয়াসার আওতায় ২৬টি খালের মধ্যে যে কয়টার এখনো নিশানা আছে, সেগুলোও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পলিথিন আর ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে

( Rahman, M. H., & Alam, K. (2016). “Urbanization and Waterlogging: A Case Study of Dhaka City.” Journal of Water Resources and Environmental Engineering, Vol. 8(4), pp. 45-52 )অনুযায়ী-
ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা বিভিন্ন গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে, যা বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে উল্লেখযোগ্য কিছু সমস্যা হলো:

জলাবদ্ধতার কারণে সড়কগুলোতে পানি জমে যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয় এতে যানজট বাড়ে এবং মানুষের কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে দেরি হয় ফলে শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেও ক্ষতি হয় দোকানপাট, অফিস এবং কল-কারখানা সময়মতো খুলতে পারে না, এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাছাড়া পানিতে বিভিন্ন রোগজীবাণু থাকে, যা পানিবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া, টাইফয়েড, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতার ফলে মানসিক চাপ এবং হতাশার সৃষ্টি হয় এবং বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান কমে যায়।

যেসব খাল এবং জলাশয় দখল বা ভরাট হয়ে গেছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা হলে জলাবদ্ধতার সমস্যা কমবে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের মাধ্যমে নতুন এবং শক্তিশালী ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণ করা দরকার, যা বড় আকারের বৃষ্টিপাত সামলাতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি, বিদ্যমান ড্রেনগুলো পরিষ্কার রাখতে নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন বর্জ্য ফেলার নিয়ম-কানুন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা উচিত, যাতে ড্রেনগুলো বন্ধ না হয়ে যায়। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার ও মেরামতের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি, যাতে তারা ড্রেন এবং খালে আবর্জনা না ফেলে এবং জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন করে। যেহেতু এটি একটি বহুমুখী সমস্যা, তাই এই সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি এবং সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.