মুজিবনগর সরকারের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহর শ্রদ্ধা জানানোর ঘটনায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে তারা বলেছে, অধ্যাপক রহমত উল্লাহর আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা নিশ্চিতপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবিলম্বে এ বিষয়ে ‘যথোপযুক্ত ব্যবস্থা’ নিতে হবে। তাঁকে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। উপাচার্য ছাত্রলীগের এসব বক্তব্যের সঙ্গে সহমত জানিয়েছেন।
আজ সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে উপাচার্যের কার্যালয়ে গিয়ে তার হাতে স্মারকলিপি তুলে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। এ সময় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মাজহারুল ইসলাম, রাকিব হোসেন, তিলোত্তমা শিকদারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা তাদের সঙ্গে ছিলেন। তবে ছাত্রলীগের এই স্মারকলিপি দেওয়ার ঘণ্টা দেড়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ‘ভুল করে থাকলে ক্ষমা প্রার্থনা’ করেছেন আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকনেতা অধ্যাপক রহমত উল্লাহ।
স্মারকলিপি দেওয়ার আগে উপাচার্যের সামনে বক্তব্য দেন সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহর বক্তব্য ছাত্রসমাজকে আঘাত করছে। এ ধরনের বক্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদার সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একে কেন্দ্র করে পরে আমরা তাঁর যে বয়ান দেখেছি, তা যথেষ্ট নয় বলে আমরা মনে করি। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে দেশের ইতিহাসের ঘৃণিত ব্যক্তি মোশতাকের নাম যখন কেউ সচেতন বা অসচেতনভাবে উচ্চারণ করেন এবং তা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্মে উচ্চারণ করেন, এর পেছনে তার (অধ্যাপক রহমত উল্লাহ) কোনো শুভ উদ্দেশ্য ছিল বলে আমরা মনে করি না৷ তার এই বক্তব্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। ছাত্রসমাজ মনে করে, এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মসূচিতে মোশতাকের কথা বলা হয়েছে, তাই এ বিষয়ে প্রশাসনকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এরপর বক্তব্য দেন সনজিত চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর সবচেয়ে ঘৃণিত যে কাজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলো, আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। এ ধরনের ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে তিনি দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি। বিষয়টি বেদনার যে তিনি শুধুই একজন শিক্ষক নন, শিক্ষকনেতাও। আমাদের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদেরও একজন তিনি। তিনি যে অপ্রকৃতিস্থ কথা বলেছেন, এর মাধ্যমে অপরাধ করেছেন। প্রকারান্তরে তিনি জাতির পিতাকে অসম্মান করেছেন এবং জাতির পিতার খুনিকে সম্মানিত করেছেন। এটি আমাদের হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে। আমরা আবারও তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে আপনি তার জন্য যে ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, তা নেবেন বলে আমরা মনে করি। আমরা চাই, তিনি যেসব দায়িত্বশীল জায়গায় রয়েছেন, সব জায়গা থেকে তিনি অব্যাহতি চাইবেন এবং জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। সংবাদ সম্মেলন করে টালবাহানাপূর্ণ কোনো ক্ষমাপ্রার্থনা আমরা মেনে নেব না।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের স্মারকলিপিটি উপাচার্যকে পড়ে শোনান সনজিত। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড, বাঙালির হৃদয়ে “কুখ্যাত মীর জাফর” হিসেবে ঘৃণিত খন্দকার মোশতাক আহমদকে জ্ঞাত-অজ্ঞাতভাবে শ্রদ্ধা জানানোর মতো যেকোনো ঘটনা-বক্তব্যকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জাতির জনকের খুনির নাম উচ্চারিত হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এ ঘটনাকে ধৃষ্টতামূলক বলে মনে করে। একই সঙ্গে শুধু বক্তব্য প্রত্যাহারই নয়, এ বক্তব্যের জন্য আমরা তাঁকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনার দাবি জানাই। রহমত উল্লাহর আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা নিশ্চিতপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবিলম্বে এ বিষয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
ছাত্রলীগের নেতাদের বক্তব্য শোনার পর উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এই সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ দিই। খুব পরিশীলিত ভাষা ও যৌক্তিক উপস্থাপনার মাধ্যমে তারা বিষয়টির নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। লিখিত ও মৌখিক যে বক্তব্য সনজিত চন্দ্র দাস ও সাদ্দাম হোসেন এখানে উপস্থাপন করল, সেগুলোর সবটাই খুবই যৌক্তিক মাত্রায়, পরিশীলিত, পরিমিত ও দায়িত্বশীলভাবেই এসেছে। আশা করি, তাদের বক্তব্যগুলোর সঙ্গে দ্বিমত করার মতো মানুষ সমাজে খুব বেশি থাকবে না। এসব বক্তব্যের সঙ্গে কেউ দ্বিমত করার কোনো কারণ খুঁজে পাবে বলে আমার মনে হয় না। এগুলোর সঙ্গে আমি সহমত জ্ঞাপন করি এবং আশা করি যে একটি সুন্দর সমাধান আসবে।
অধ্যাপক আখতারুজ্জামান আরও বলেন, ছাত্রলীগ যেভাবে দায়িত্বশীল আচরণের মধ্য দিয়ে বিষয়টির প্রতিবাদ করল, এভাবেই মূলত যেকোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বাংলাদেশ, মহান ভাষা আন্দোলন—এই মূল্যবোধের সঙ্গে আমরা কোনোভাবেই কোনো অপশক্তি, ষড়যন্ত্রকারী বা ঘৃণিত মহলের কোনো ধারণা, মত বা দর্শনের প্রতিফলন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং বিশেষ করে এই জাতি কখনো গ্রহণ করবে না। এসব বিষয়ে আমরা খুবই যত্নশীল।
গতকাল রবিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে মুজিবনগর সরকারের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতিও ‘শ্রদ্ধা’ জানান বলে অভিযোগ ওঠে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ ওই বক্তব্য নিয়ে আপত্তি জানালে ওই সভাতেই সভাপতির বক্তব্য দিতে গিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান মো. রহমত উল্লাহর বক্তব্যের ওই অংশ প্রত্যাহার করেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নীল দলের প্যানেল থেকে তিনি শিক্ষক সমিতির সভাপতির পাশাপাশি আইন অনুষদের ডিনও নির্বাচিত হয়েছেন।