এমনিতেই ছিল বাঁচা–মরার লড়াই, ম্যাচের আগে দুই দলের বাগযুদ্ধে আবহটা রূপ নিয়েছিল যুদ্ধের। আফগানিস্তানের বিপক্ষে হারের পর সংবাদ সম্মেলনে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক দাসুন শানাকার একটা কথাকে কেন্দ্র করে শুরু বিবাদ শুধু দুই দলের খেলোয়াড়–কর্মকর্তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাতে যোগ দিয়েছিলেন মাহেলা জয়াবর্ধনের মতো সাবেকরাও। ২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফির স্মৃতি ফিরিয়ে এনে রীতিমতো টগবগ করে ফুটছিল দুই দল। মাঠের খেলাটাও এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণই হলো। দারুণ এক ম্যাচ!
নিরপেক্ষ দর্শকের কাছে ম্যাচটা দারুণ মনে হতে পারে, শ্রীলঙ্কার কাছে তো অবশ্যই। কিন্তু বাংলাদেশের কাছে? প্রশ্নই আসে না। যে ম্যাচে পরাজয় শুরু হতে না হতেই শেষ করে দিয়েছে বাংলাদেশের এশিয়া কাপ—সেটিকে কি আর ‘দারুণ ম্যাচ’ হিসেবে মনে রাখা যায়! বাংলাদেশ এই ম্যাচ মনে রাখবে নিদারুণ আশাভঙ্গের এক ম্যাচ হিসেবে। ১৮৩ রান করার পরও হার, ম্যাচের বেশির ভাগ সময় জয়ের সুবাস পাওয়ার পরও হার—যেটির জন্য ভাগ্যকে দুষবারও কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশ হেরেছে নিজেদের দোষেই।
বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কা, শ্রীলঙ্কার প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ—এর বাইরে অদৃশ্য এক প্রতিপক্ষ কমন হয়ে ছিল দুই দলের জন্যই। সেই প্রতিপক্ষের নাম ‘চাপ’। হেরে গেলেই সুপার ফোরে দর্শক বনে নিয়ে এশিয়া কাপ থেকে বিদায়—এই বিষম চাপটা সামলাতে পারা না–পারাটাই হয়তো নির্ধারক হয়ে গেল এই ম্যাচের। বাংলাদেশের বোলারদের ৮টি ওয়াইড আর ৪টি নো বলের ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলেও হয়তো ওই চাপ নিতে না পারাটাই সামনে এসে দাঁড়াবে।
ম্যাচটা বাংলাদেশ কোথায় হারল—এই ময়নাতদন্তও যেন এক মিনিটের মামলা। শ্রীলঙ্কান বোলাররা একটা নো বল করেননি, একটাও ওয়াইড না। নো–ওয়াইডের ১২ রানের সঙ্গে ১২টি বাড়তি বলে আসা রান হিসাব করলেই তো হারের ময়নাতদন্ত শেষ।
টি–টোয়েন্টি এমনিতেই ছোট খেলা। বোলারদের জন্য তা আরও ছোট। ম্যাচে তাঁদের ভূমিকা মাত্রই তো ৪টি ওভারে সীমাবদ্ধ। সেই ৪ ওভারের মধ্যেই কখনো কখনো পুরো বিপরীত মেরুর অভিজ্ঞতা ধরা থাকে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো এই ম্যাচের ইবাদত হোসেন। টি–টোয়েন্টিতে তাঁর অভিষেক ম্যাচ। প্রথম ওভারেই নিয়ে নিলেন ২ উইকেট। দ্বিতীয় ওভারে আরেকটি। প্রথম ২ ওভারে ১৩ রান দিয়ে ৩ উইকেট—হাই স্কোরিং এই ম্যাচেও তখন তাঁকে মনে হচ্ছে ম্যাচ–সেরার স্বীকৃতির দাবিদার। সেই ইবাদতই ম্যাচ শেষ করলেন ৪ ওভারে ৫১ রান দিয়ে!
হিসাবটা কি করে ফেলেছেন এরই মধ্যে? হ্যাঁ, শেষ ২ ওভারে ইবাদত দিয়েছেন ৩৮ রান। ম্যাচের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির আগেই সেটির একরকম মীমাংসাও তাঁরই ব্যর্থতায়। শেষ ২ ওভারে শ্রীলঙ্কার যখন ২৬ রান দরকার, ১৯তম ওভারে নো–ওয়াইডসমেত ১৭ রান দিয়ে ফেললেন ইবাদত। আশ্চর্য এক ওভার! নো বল, ওয়াইড বল, লেগ বাই, চার…এর সঙ্গে আবার একটাও রান আউটও! শ্রীলঙ্কা তখন এমন মোমেন্টাম পেয়ে গেছে যে, শেষ ওভারে শেখ মেহেদীর ৮ রান আটকাতে পারাটাই হতো বিস্ময়কর। প্রতীকীই বলতে হবে, বাংলাদেশের বোলারদের ভুলে ভরা ম্যাচটার সমাপ্তিও হলো একটি নো বলের মাধ্যমে।
ভুলের কথা বললে অবশ্য সবার আগে আসে মুশফিকুর রহিমের নাম। তাসকিনের বলে যখন কুশল মেন্ডিসের ক্যাচ ছাড়লেন বাংলাদেশের উইকেটকিপার, তাঁর রান তখন মাত্র ২। বিড়ালের নাকি নয়টি জীবন থাকে, এদিনের কুশল মেন্ডিস যেন সেই ‘অমর বিড়াল’। ৩৭ বলে ৬০ রানের ইনিংসে ম্যাচ–সেরার পুরস্কার উঠেছে তাঁর হাতে। যে ইনিংসটা তিনি একা খেলেননি, তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে খেলেছে ভাগ্যও। আউট হতে হতে বেঁচে গেছেন চার–চারবার। সেই বেঁচে যাওয়াতেও কত বৈচিত্র্য! একবার ক্যাচ পড়েছে, একবার আউট হয়েছেন নো বলে, নিশ্চিত রান আউট থেকে মুক্তি পেয়েছেন আরেকবার, আরেকবার বল ব্যাটে লাগার পরও বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা তা বুঝতেই পারেননি।
নো–ওয়াইডের বন্যা আর ক্যাচ ফেলায় ম্যাচটা বিসর্জন না দিলে এ দিন বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা নিয়ে হয়তো প্রশংসাই করা যেত। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে পরাজয়ের চেয়েও হতাশাজনক ছিল, বদলের ঢাকঢোল পিটিয়ে এশিয়া কাপে গিয়ে বাংলাদেশের সেই রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপেই বন্দি হয়ে থাকা। গৎবাঁধা একাদশ, ইনিংসের শুরুতে চেনা মুখ, এর পরের ব্যাটিং অর্ডারেও উদ্ভাবনী কিছু নেই, অ্যাপ্রোচে তো….। মোসাদ্দেক হোসেন ছাড়া আর কারও ব্যাটিংয়েই টি–টোয়েন্টির রণদুন্দুভি বাজেনি। আফগানিস্তান যেখানে টি–টোয়েন্টির আধুনিক যুগের বিজ্ঞাপন, বাংলাদেশ যেন মান্ধাতা আমলের বস্তাপচা দর্শনের প্রতিভূ।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নতুন কিছু চেষ্টা করা ছাড়া উপায় থাকে না। বাঁচা–মরার ম্যাচে বাংলাদেশও তাই একরকম বাধ্যই হয়েছিল নতুন পথে হাঁটতে। ক্রিকেটে স্কিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে মনের ভূমিকাও খুব কম নয়। মন মানে মানসিকতা—সেই মানসিকতার বদলের আভাস পাওয়া গিয়েছিল ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই। আগের ম্যাচের একাদশে তিনটি বদলে যেটির প্রতিচ্ছবি। প্রথম ম্যাচের দুই ওপেনারই বাদ। বদলে যাঁদের নামিয়ে দেওয়া হলো, কেউই এর আগে আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে ওপেন করেননি। একজনের তো আবার তিন বছর পর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে প্রত্যাবর্তন। সেই প্রত্যাবর্তনকে রাঙিয়ে রাখতে পারেননি সাব্বির রহমান। আউট হয়ে গেছেন মাত্র ৫ রানে। কিন্তু ওটুকুর মধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই দিন বাংলাদেশ মরলে বীরের মতোই মরার প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নেমেছে। প্রথম বলেই সাব্বিরের প্যাডল সুইপে চার সেটিরই প্রমাণ।
২৬ বলে ৩৮ রান করে মিরাজ আবারও বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর ক্রিকেটীয় মন্ত্র—‘যখন যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই আমি আছি’। পাওয়ার প্লেতে ৫৫ রান তুলে ফেলার রেশ ধরেই ব্যাটিং করেছেন পরের ব্যাটসম্যানরাও। পুরোভাগে যথারীতি আফিফ হোসেন। বাংলাদেশের এই দলে টি–টোয়েন্টি ব্যাটিংটা তাঁর ব্যাটেই সবচেয়ে বেশি মূর্ত হয়। ২২ বলে ৩৯ রানে আবারও যার প্রমাণ। সেই ইনিংসটাও এসেছে কোন সময়ে! যখন প্রিয় প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙতে ব্যর্থ মুশফিক (৪), সাকিবের ইনিংসটা পাখা মেলতে মেলতে মুখ থুবড়ে পড়েছে—৮৭ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ায় মূল্যহীন হয়ে যেতে বসেছে দারুণ সূচনা।
মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে আফিফের ৩৭ বলে ৫৭ রানের জুটি সেখান থেকে আবার টেনে তুলেছিল ঠিকই, কিন্তু চার বলের মধ্যে দুজনই ফিরে আসার পর আবারও একটু মেঘাচ্ছন্ন বাংলাদেশের আকাশ। সেই মেঘ দূর করে রোদ এনেছিল মোসাদ্দেকের ব্যাট। আগের ম্যাচে ৩১ বলে ৪৮ করে অপরাজিত ছিলেন। স্ট্রাইক রেটের হিসাবে এদিনের মোসাদ্দেক আরও বিধ্বংসী—৯ বলে অপরাজিত ২৪, স্ট্রাইক রেট ২৬৬.৬৬।
এসব আর এখন কার মনে রাখার দায় পড়েছে! নিদারুণ সত্যি তো এটাই যে, গত চারটি এশিয়া কাপের তিনটিরই ফাইনাল খেলা বাংলাদেশ এবার টুর্নামেন্ট শুরুর পাঁচ দিনের মাথায়ই পরিণত হয়েছে দর্শকে। এশিয়া কাপ এখন অন্যদের খেলা, বাংলাদেশের নয়।