The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪

ইবিতে সার্টিফিকেট উত্তোলন: প্রতিদিন হয়রানির শিকার শতাধিক শিক্ষার্থী

মোস্তাক মোর্শেদ ইমন: বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের উচ্চতর শিক্ষা শেষ করে স্বীকৃতির জন্য শেষ চাওয়াটা সার্টিফিকেট। তবে সেই সার্টিফিকেট নিতে এসে যদি হতে হয় হয়রানি। শিকার হতে হয় নানা ভোগান্তি সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের খারাপ আচরণের তবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সার্টিফিকেট উত্তোলন হয়ে যায় অভিশাপ। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) প্রশাসন ভবনে সার্টিফিকেট তুলতে আসা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে নিয়মিত চিত্রটি ঠিক এমনি। অব্যবস্থাপনার চরম পর্যায়ে পৌছেছে প্রশাসন ভবনের উত্তর ব্লকের তিনতলায় অবস্থিত সার্টিফিকেট প্রদানকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের এই দপ্তরটি। বার বার অভিযোগ দিয়েও যেনো কোন ফল পাওয়া যায়না সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তাকে। যার ফলে হয়রানিকেই স্বাভাবিকভাবে নিয়ে মুখে কুলুপ এটে বসে থাকেন শিক্ষার্থীরা।

সরেজমিনে প্রশাসন ভবনের সার্টিফিকেট প্রদানকারী এই দপ্তর গুলো ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো তথ্য কেন্দ্র। কোন কক্ষে গেলে মিলবে কাংখিত নথিটি তাও জানানোর কেউ নেই। কক্ষে কক্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীদেরই ঘুরে ঘুরে জানতে হয় সকল তথ্য। সেই সাথে কাউন্টারে বসে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে পেতে হয় নানা রকমের তিরস্কার যা একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর মনকে ভেঙ্গে দেয় এবং যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি জন্ম দেয় নেতিবাচক ধারনাও।

জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে শ’ খানেক শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট তুলতে আসেন প্রশাসন ভবনে। তবে চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে যা প্রায় ৪০০/৫০০ তে গিয়েও দাড়ায়। সেই হিসেবে দপ্তরটিতে সার্টিফিকেট উত্তোলনে সহায়তাকারী সংশ্লিষ্ট কর্মচারী মাত্র ৫/৬ জন। সেক্ষেত্রে সার্টিফিকেট উত্তোলন করতে আসা সবাইকেই পড়তে হয় কোনো না কোনো হয়রানির মুখে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ৪৬ তম বর্ষে এসেও হাতেগোনা কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া আধুনিকতার ছোয়া পায়নি। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অর্জনের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে সার্টিফিকেট উত্তোলন।

এছাড়াও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এই কার্যালয়ে থাকা গোপনীয় কক্ষটিও কর্মচারী সংকটে এখন উন্মুক্ত। শিক্ষার্থীদের সেখানে নিজে এসে কাগজ খুজে বের করতে হয়। যার ফলে একজন শিক্ষার্থীর সারাজীবনের ফসল এই সার্টিফিকেটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে থেকেও তীব্র অনিরাপত্তায়।

প্রশাসন ভবন সূত্রে, প্রতিটি বিভাগের ফল প্রকাশ, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, নম্বরপত্র ও সনদপত্র প্রদানের কাজ করে থাকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর। প্রশাসন ভবনের উত্তর ব্লকের তিনতলায় অবস্থিত এই দপ্তরের কাউন্টার ও অফিস কক্ষগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভিড় থাকে সব সময়। নিয়মানুযায়ী একজন শিক্ষার্থী এসব কাগজপত্র জরুরি ভিত্তিতে আবেদনের ৫ দিন এবং জরুরি বাদে ১৫ দিনের মধ্যে পাওয়ার কথা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নিয়ম মেনে আবেদনপত্র দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় কেটে গেলেও কাঙ্ক্ষিত কাগজপত্র মেলে না। অনেক সময় মাসের পর মাস কেটেও যায়। ঘটে আবেদনপত্র হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনা। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাজের প্রতি অবহেলাকে দায়ী করেন শিক্ষার্থীরা।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসসহ প্রশাসন ভবনের সকল দপ্তর গুলোকেই শিক্ষার্থী বান্ধব করাটা এখন সকল সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের একমাত্র দাবী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনিল মোমেন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের পড়াশোনা করার পুরো সময়টায় আমরা যে কষ্ট করি সার্টিফিকেট তুলতে এসেও একি পরিমান কষ্ট। সবচেয়ে বড় বিষয় এখানে অসহযোগিতা। কেউ কাউকে সহযোগিতা করেনা। আমরা যদি কোনো কাগজের জন্য আসি তখন বলে, দেখেন, জানিনা, ব্যস্ত আছি, কাজ করতেছি। এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে ঘোরায়। ২০ দিন ৩০ দিনেও আমাদের নথিটা পাইনা। এখানে যে নিয়ম সেই অনুযায়ী কিছুই হয়না। দেখা যায় আমাদেরই সেই কাগজ খুজে বের করে দপ্তরে দপ্তরে ঘুরতে হয়। বেশীরভাগ সময়তো আবেদনের কাগজটিই হাওয়া হয়ে যায়।

ট্যুরিজম এবং হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের রিজওয়ান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, অনেক সময় আমরা জরুরী ভিত্তিতে কাগজ তোলার জন্য টাকা জমা দেই তারপরও আবার আমাদেরই কাউন্টারে কাউন্টারে, গোপনীয় কক্ষে বার বার গিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। আমরা এসে শুধু ঘুরতে থাকি আর একেকেজন কর্মকর্তা এসে বলেন শুধু এই রুমে যান ওই রুমে যান। যা একজন শিক্ষার্থী হয়ে আমাদের কাছে হয়রানি।

নিজেদের এমন অপারগতা স্বীকার করে জনবল ও জায়গার সংকটকে দায়ী করেছেন ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, নিচের দিকের কর্মচারী লেভেলের তীব্র সংকট। এমন অবস্থায় পরীক্ষার সময়গুলোতে আবার এখান থেকে কর্মচারী পাঠাতে হয়। যার ফলে আমাদের এই কাজগুলো করতে দারুণ বেগ পেতে হচ্ছে। আমাদের জায়গারও সংকট রয়েছে। যার ফলে আমাদের সার্টিফিকেট রুমে পর্যাপ্ত সিকিউরিটি নাই। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের জন্য একটি স্বতন্ত্র জায়গা থাকা বাধ্যতামূলক যেখানে গোপনীয়তা বজায় রাখা যাবে। যা আমাদের এই মুহুর্তে জরুরী প্রয়োজন।

ইবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাহেদ আহম্মেদ বলেন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি নতুন নয়। বিশেষ করে গত ১৫ বছর দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা ছিল লাগামহীন। অফিস না করে খামখেয়ালী পনা করে অনেকেই আড্ডাবাজি করতো। কর্মকর্তা কর্মচারীরা সময়ের কাজ সময়ে করেনি, যে কারণে ভোগান্তি বেড়েছে। মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের সঙ্গে আমরা এ বিষয়ে কথা বলব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে যে হ য ব র ল অবস্থা আছে এবং অতীতে ছিল তা নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে ছাত্রদল কাজ করে যাবে ইনশাআল্লাহ।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ও জিয়া পরিষদের শিক্ষকনেতা অধ্যাপক ড. মিজানূর রহমান বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরোবার পরই শিক্ষার্থীরা এমন ভোগান্তির মুখে পরে। আমাদের নতুন একটা প্রশাসনিক ভবনের কাজ ইতোমধ্যে চলমান। সেখানে যদি কন্ট্রোলার অফিসটা স্থানান্তর করে দেয়া যায় তখন ছাত্রছাত্রীরা এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাবে। আর আপাত প্রতিকারের জন্য খুব দ্রুত এই প্রক্রিয়াটি ডিজিটাইলেজেশন করা যেতে পারে। বিষয়টা নিয়ে প্রশাসনের সাথে আমরাও কথা বলব।

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এ কে এম মতিনুর রহমান বলেন, একটা শিক্ষার্থীর চার বছর সফল ভাবে অনার্স শেষ করার পর সার্টিফিকেট তুলতে গিয়ে যে ভোগান্তির শিকার হয় তা দূর্ভাগ্যজনক। তার জন্য কষ্টেরও। এই বিষয়ে প্রশাসনের কাছে প্রস্তাব জানাবো যে, বর্তমান যুগ ডিজিটাল যুগ। এই যুগে ডিজিটাল কার্যক্রমের কোনো বিকল্প নেই। এই প্রক্রিয়াকে অটোমেশন প্রক্রিয়ায় স্থানান্তর করা যায় তাহলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি যেমন কমবে তেমনি সময়ও অনেক সাশ্রয় হবে। আর দপ্তরটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বলতে চাই, শিক্ষার্থীদের প্রতি একটু নমনীয় হতে। তারা আমাদের সন্তানের মতোই। তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা আমাদের দায়িত্ব।

ভোগান্তি নিরসনের বিষয়ে নিজের পরামর্শমূলক বক্তব্যে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এমতাজ হোসেন বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদ রয়েছে ৮ টি। অনুষদগুলোতে একজন করে এসিস্ট্যান্ট বা ডেপুটি রেজিস্ট্রার দিতে হবে। যিনি শুধু মাত্র সার্টিফিকেট ভিত্তিক কাজকর্ম গুলো করবে। সাথে পরীক্ষা কন্ট্রোল অফিসে একজন অফিসার ও একজন পিয়ন নিয়ে হেল্প ডেস্ক তৈরি করা। সার্টিফিকেট উত্তোলনের সকল নির্দেশনা এই ডেস্কেই থাকবে। শিক্ষার্থীরা তাদের সকল রকমের কাগজপত্র ডেস্কে গিয়ে জমা দিলে ডেস্কের দায়িত্বে যারা থাকবেন তারা কাগজপত্র গুলো নিয়ে অনুষদগুলোর সেই অফিসারের কাছে জমা দিবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আর তাদের কাগজপত্র গুলো কখন কোথায় যাবে তা আর জানার দরকার পড়বে না। শিক্ষার্থীদের কাজ হবে শুধু দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে কাগজ জমা দেয়া আর আরেকটি নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে সার্টিফিকেট অথবা অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিও অনেকটা কমে যাবে। তবে এই ম্যানুয়েল সিস্টেমটি সাময়িক। এর স্থায়ী একমাত্র সমাধান হচ্ছে অটোমেশন।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এই অফিসটিকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃৎপিন্ড আখ্যা দিয়ে ধর্মতত্ত্ব অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. আ ব ম সিদ্দিকুর রহমান আশ্রাফি বলেন, এই হৃৎপিন্ডটা যদি ঠিক তবেই বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক থাকবে। আমি এই ভোগান্তি দূরীকরনে পরামর্শ দিতে পারি আমাদের রিসিপ্ট গুলো যেগুলো হারিয়ে যায় তা রক্ষণে ব্যবস্থা নিতে হবে। পর্যাপ্ত কক্ষ থাকাটা এক্ষেত্রে মূখ্য সেইসাথে রুম ও কাউন্টার গুলোতে যদি পয়েন্টিং করে উল্লেখ করে দেয়া হয় কোন কক্ষে কি কাজ সেটিও শিক্ষার্থীদের সমস্যাটা একটু হলেও লাঘব করবে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকিব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি ইতোমধ্যেই অবগত। সার্টিফিকেট উত্তোলনে অটোমেশন সার্ভিস চালু করতে আমাদের একটি কোম্পানির সাথে প্রাথমিকভাবে কথা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই ভোগান্তি গুলো শেষ করা প্রয়োজন। বিষয়গুলো নিয়ে আমি আমার শিক্ষকদের কাছ থেকেও অভিযোগ পেয়েছি। কিভাবে এই প্রক্রিয়াটি ওয়ান স্টেপ সার্ভিসের আওতায় আনা যায় তা আমাদের পরিকল্পনায় আছে। অলরেডি প্রভোস্ট কাউন্সিলের মিটিংয়েও বিষয়টি তোলা হয়েছিলো। আশা করা যায় খুব দ্রুতই বিষয়টি সমাধানে আসবে।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.