পথ হারাচ্ছে তারুণ্য
আফরোজা আক্তারঃ দেশে নতুন আতঙ্কের নাম অনলাইন জুয়া। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে জুয়া খেলা বহু পুরনো এবং প্রচলিত একপ্রকার অবসর-বিনোদনের মাধ্যম। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সঙ্গে জুয়ার অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে অনলাইন জুয়াতেই এখন মানুষের অংশগ্রহণ বেশি। এক ধরনের কৌতূহল থেকে তরুণ প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে। শুধু যুবকেরা নন, বিভিন্ন বয়সী মানুষ এতে জড়িয়ে পড়ছেন। এ জুয়ার আসর শহর ছাড়িয়ে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে।
অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে চলে এসব জুয়ার আসর। মোবাইল ফোনে অনলাইন জুয়ার অ্যাপস ডাউনলোড করে সেই অ্যাপসের লিংক অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে চালানো হয় জুয়া। কোভিডের সময় ঘরবন্দি অনেক মানুষ সময় কাটাতে গিয়ে অনলাইন জুয়ার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। ওয়ানএক্সবেট, বেটবাজডট৩৬৫, ক্রিকেক্স, বেট৩৬৫এনআই ও মসবেটসহ বিভিন্ন জুয়ার সাইটে টাকা পাচার হচ্ছে। চক্রগুলো হুন্ডি, ক্রিপ্টোকারেন্সি, মোবাইল ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চলে জুয়ার টাকা লেনদেন করছে। প্রথমে অল্প কিছু টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে শুরু করে খেলা। একপর্যায়ে লোভে পড়ে খোয়াচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
এসব জুয়ার সাইটের অধিকাংশ পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব জুয়ার সাইট বাংলাদেশেও পরিচালনা করছে তাদের এজেন্টরা। জুয়ায় বিনিয়োগের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। জুয়ায় টাকা ঢুকালে সাবএজেন্টরা ৫ শতাংশ কমিশন পান। আবার টাকা কেউ উঠালে ৭ শতাংশ কমিশন দিতে হয়। একজন সাবএজেন্টের আন্ডারে যদি প্রতিদিন ২০ লাখ টাকাও জুয়ায় লেনদেন হয়, তা হলে কমিশন হিসেবে তিনি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পান। সাব-এজেন্টের কয়েকগুণ বেশি কমিশন পান মাস্টার এজেন্ট। সাব এজেন্ট সাধারণ জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। টাকা গ্রহণ ও উত্তোলন মূলত সাব-এজেন্টদের মাধ্যমেই হয়।
ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, অনলাইন জুয়ায় বাজারমূল্যের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। ২০২২ সালে শুধু অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ৬ হাজার ৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে এর ব্যাপ্তি ১১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কয়েক হাজারের বেশি জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে সরকার কিন্তু জুয়ার সাইট এ দেশে বন্ধ করলেও জুয়াড়িরা ভিপিএন বা অন্য উপায়ে ঠিকই সাইট ব্যবহার করছে।
জুয়ার মাধ্যমে যে শুধু দেশের কিংবা ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থার ক্ষতি হচ্ছে ব্যাপরটা তা নয়। জুয়ার কারণে সংসারে অশান্তি, সন্তান বা সঙ্গীর বিপথগামিতা, বিবাহ বিচ্ছেদ, ত্যাজ্য সন্তানে পরিণত হওয়া, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মত সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত আজ অসংখ্য পরিবার। অন্যদিকে দেউলিয়া হয়ে পথে বসা, ব্যবসার ভরাডুবি, ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়া, সম্পত্তি বিক্রি, অলংকার আসবাব বিক্রির করার মত অর্থনৈতিক সংকটও ঘটছে জুয়ায় আসক্তির কারণে। চূড়ান্ত পরিণতিতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা কিংবা আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মত ঘটনাও ঘটছে।
জুয়া খেলায় আসক্ত ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমে তার সমস্যাটা ভালো করে বুঝতে হবে এবং এই নেশা থেকে বের হতে তাকে উৎসাহ দিতে হবে। ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং অতীতের কথা আলোচনা করা যাবে না। শুধুমাত্র বর্তমানের সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে এবং জুয়া কীভাবে একজন মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনছে সেই বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা জরুরি। এক্ষেত্রে জুয়ার নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ না করে বুঝিয়ে বলতে হবে। জুয়া খেলার মতো বদ অভ্যাস মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে সেই বিষয়ে একজন জুয়াড়িকে সতর্ক করতে হবে।
সামাজিক সংগঠনগুলো জুয়ার কুফল ও ভয়াবহতা সম্পর্কে এলাকায় সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। জুয়ার কার্যক্রম বন্ধ করতে সরকারের আইটি সংস্থা কর্তৃক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, জুয়ার জন্য জুয়ারি তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। কিন্তু এই আইনটিও মানা হচ্ছে না।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জুয়া বন্ধে সরকারের কোনো কঠোর আইন নেই। সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট আকুল আবেদন, যত দ্রুত সম্ভব অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে দেশ ও জাতির মুক্তির ব্যবস্থা করুন। মানুষকে শারিরীক, মানসিক, অর্থনৈতিক সবদিক থেকেই পুঙ্গ করে মেরে ফেলার মত মানববিধ্বংসি এই মোবাইল জুয়া কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। তাই সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ।