জাবি প্রতিনিধি: অদৃশ্য কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ১৭টি আবাসিক হলে ছাত্রলীগের কমিটি হচ্ছে না। হলগুলোতে কর্মী সভা করার পরও নানা অজুহাতে পেছানো হয়েছে কমিটি গঠনের কার্যক্রম। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনার পরও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের টনক নড়ছে না। এদিকে গত ১৪ মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ফলে হল কমিটিতে পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি আকতারুজ্জামান সোহেলকে সভাপতি এবং মো. হাবিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে শাখা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরে একই বছরের ৩০ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। এরপর গত বছরের ৩ জানুয়ারি একবছর মেয়াদি বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। যদিও এখনও নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এদিকে হল কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে সবগুলো হলে কর্মীসভা আয়োজন করা হয়। এছাড়া কমিটির বিষয়ে নেতাকর্মীদের বারবার আশ্বস্ত করলেও কার্যত কোনো উদ্যোগ নেয়নি মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির নেতারা। ফলে হল কমিটি নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে আছে পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীরা।
এদিকে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি হল কমিটি না দেওয়াসহ নানা অভিযোগে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তার অনুসারীরা। সেসময় হল কমিটির দাবিতে বিক্ষোভ করেন ছাত্রী হলের নেত্রীরা, বিক্ষোভ থেকে হল কমিটি ঘোষণা করার জন্য ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দেন। পরে তড়িঘড়ি করে শেখ হাসিনা ও শেখ রাসেল হলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে অন্য কোনো হলের কমিটি গঠন করা হয়নি।
অন্যদিকে গত ৩০ মার্চ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাবি শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভা করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এই মতবিনিময় সভায় জাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লিটনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এমনকি পরবর্তীতে কেউ বিদ্রোহ করলে তাকে বহিস্কার এবং রাষ্ট্রীয় বিশেষ সংস্থা দিয়ে হেনস্থা করার হামকি দেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে হল কমিটি করার নির্দেশ দেন। তবে এখনও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা।
ছাত্রলীগের একটি সুত্র জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে অবস্থানরত ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাদের কারণেই হল কমিটি হচ্ছে না। কেননা হল কমিটি গঠনের পর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অর্থনৈতিক বিষয়সহ সবকিছুর হিসাব পাল্টে যাবে। তখন সিনিয়র নেতারা আর্থিক বিষয় থেকে বঞ্চিত হবেন। এমনকি তাদের ক্ষমতা রদবদল হবে। তাই প্রকাশ্যে না করলেও গোপনে তারা হল কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ায় বাঁধা দিচ্ছেন।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে হল কমিটি না হওয়ায় পদপ্রত্যাশী কর্মীদের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছে। বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকেও স্ট্যাটাস দিয়ে কমিটি চেয়েছেন ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। এমনকি ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে আসতেও আগ্রহ হারিয়েছেন অনেকে। এছাড়া তৈরি হয়েছে গ্রুপিং, ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড। এমন সব কথা বলছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ এক নেতা বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে নেই চেইন অব কমান্ড, নেই শৃঙ্খলা। হল কমিটি না হওয়ায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক ছাড়া কেউই খুশি না। তারা শুধুই আশ্বাস দিয়েই দীর্ঘদিন পার করলেন।’
রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী নাসরিন পারভীন অরিন বলেন, ‘ছয় বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে আছি। এখনো পর্যন্ত কোন পদ পদবী নেই। তাহলে আমাদের পরিচয়টা কি? আমরা চাই, দ্রুত হল কমিটি ঘোষণা করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগকে প্রাণবন্ত ও গতিশীল করা হোক।’
মীর মশাররফ হোসেন হলের সভাপতি পদপ্রত্যাশী সৌরভ মাজহার বলেন, ‘এখনো ভাইদের আশ্বাসের উপর আছি। আশা করি, খুব দ্রুত হল কমিটি দেওয়া হবে।’
সুফিয়া কামাল হলের সভাপতি পদপ্রত্যাশী সাবরিনা সিদ্দিকা অদিতি বলেন, ‘আমরা গণরুমে থেকে রাজনীতি করে এসেছি। প্রতিটি প্রোগ্রামে প্রথম সারিতে থাকি। কর্মীদের নিয়ে হলকে সচল রেখেছি। ভাইয়েরা বার বার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন হল কমিটি দেওয়ার। তারপরও হল কমিটি না দেওয়া আসলে দুঃখজনক। কিছুদিন পর গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে যাবে। তাহলে আমার প্রাপ্তিটা কী? এছাড়াও দিন দিন জাবি শাখা ছাত্রলীগে নারী নেত্রীদের অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে এই যে মূল্যায়ন না হওয়া। হল ছেড়ে চলে যাবো তাহলে আমাদের রাজনৈতিক পরিচয়টা কি থাকল আর?’
ফজিলাতুন্নেসা হলের পদপ্রত্যাশী আফরিন আলম রিমি বলেন, ‘হল ইউনিটগুলোকে জাবি ছাত্রলীগের হার্ট বলা যায়। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ অংশকে দীর্ঘদিন কমিটি শূন্য রাখাটা আমাদের সকলের জন্য হতাশাজনক। দিনের পর দিন আমরা কর্মী হারাচ্ছি। জুনিয়ররা প্রোগ্রাম করার আগ্রহ পায় না। এতে পুরো জাবি ছাত্রলীগই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দু’টি হলের কমিটি হওয়ার পর আমরা আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু এতদিন পার হলেও আমরা কমিটি পাচ্ছি না। আমরা এই মাসের মধ্যে কমিটি চাই। আমরা এতদিন আমাদের দুই অভিভাবকের উপর ভরসা রেখেছি। আমরা চাই, আমাদের সেই ভরসার জয় হোক।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, ‘আমরা পদপ্রত্যাশীদের খোঁজ-খবর নিয়েছি। আদর্শের বাইরে কেউ যাতে আসতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছি। আর ত্যাগী ও পরিশ্রমীরাদের পদ দেওয়া হবে। আমরা শীঘ্রই হল কমিটি দিয়ে দিবো।’
সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান লিটন বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা অতিসত্তর কমিটি দিয়ে দিবো। আসন্ন হল কমিটিতে যারা আসছে তারা গ্রহণযোগ্য, পরিচ্ছন্ন হবে সেভাবেই আমরা কাজ করছি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।