The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪

সাগর দেওয়ানের কণ্ঠের জাদুতে বশ হয়েছে বিতর্ক

সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলা থেকে প্রকাশিত হয়েছে “মা লো মা” গানটি। গানটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই গানটির প্রকৃত স্বত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়। কোক স্টুডিওতে গানটি পরিবেশনের সময় বাউল সাধক খালেক দেওয়ানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই গান প্রকাশ এবং নাম উল্লেখ করার পর থেকেই বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের অনুসারীরা দাবি করছে গানটি তার রচিত। এখন কথা হচ্ছে “মা লো মা” গানটি আমি প্রয়াত খালেক দেওয়ানের নিজের মুখের একটি ভার্সন শুনেছি সেখানে তিনি এই গানকে নিজের লিখা গান বলে উচ্চারণ করেছেন।

রশিদ উদ্দিন সাহেবের লেখা গানটিও শুনেছি দুইটি গানের কথার মধ্যে সম্পূর্ণ মিল নেই, দুটির মধ্যে কিছু ভিন্নতা দৃশ্যমান।

এখনো আমাদের দেশে কয়েক প্রজন্মের মানুষ আছে, জ্ঞানী- গুনী, সাধক শ্রেণী, থেকে শুরু করে অনেক প্রবীণ ও বিজ্ঞজনদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি যে রশিদ উদ্দিন সাহেব যে গানটি লিখেছেন এবং খালেক দেওয়ান সাহেব যে গানটি লিখেছেন দু’টি গানের কথার ভেতর বেশ ভিন্নতা রয়েছে। গানের ভেতর অনেক কথা ও ভাষার ভিন্নতা রয়েছে। তারা বলছেন তৎকালীন সময়ে “মা লো মা, ঝি লো ঝি” বা “মাগো মা ঝিগো ঝি” এগুলো প্রচলিত বাগধারা বা শ্লোকোর মত ছিলো। অনেকেই এই শ্লোককে ব্যবহার করে গান লিখতেন, কবিতা লিখতেন। সেক্ষেত্রে “মা লো মা বা মাগো মা” থাকলেই সে গান শুধুমাত্র একজনেই এটা দাবী করার কোন সুযোগ নেই। খালেক দেওয়ান সাহেবের নিজের প্রকাশিত যে গীতবিতান রয়েছে সেখানেও তার এই গানটি রয়েছে। তার সমসাময়িক অনেক প্রবীণ ব্যক্তি জানিয়েছেন গানটি তার নিজের লিখা এবং তিনি এটি অনেক বার অনেক স্থানে গেয়েছেন বলে ব্যক্ত করেছেন। আবার অনেক প্রাজ্ঞজন বলেছেন এই গানটির রশিদ উদ্দিনের রচিত একটি ভার্সনও রয়েছে যেখানে ভাষাগত কিছু ভিন্নতা রয়েছে রশিদ উদ্দিনের গানটি মূলত “মাগো মা ঝিগো ঝি” কিন্তু খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ।

আবার অনেক গবেষক বলছেন যে সংগীতের ক্ষেতেও অনেক কাকতালীয়তা থাকে সেক্ষেত্রে এখানেও হয়তো এই গান রচনার ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটে থাকতে পারে। যেমন একজনের ভাবের সাথে আরেকজনের ভাব মিলে যেতে পারে বা কারো গানের কথার সাথে আরেকজনের কথাও মিলে যেতে পারে অলৌকিক ভাবেই। যেটা আমাদের সম্পূর্ণ ভাবে বিচার করার সুযোগ নেই।

এবার মূল কথায় আসা যাক। গানটি নিয়ে যে দুজন রচয়িতা সম্পর্কে বিতর্ক হচ্ছে তারা দুজনই এখন প্রয়াত। তারা দুজনই ছিলেন বাউল সাধক। এখন তারা আর কেউ এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তৎকালীন সময়ে এই সাধক ও সংগীত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গুরু ভিত্তিক চর্চার ব্যবস্থা ছিলো। সেখানে একে অপরের সাথে দেখা হতো কথা হতো বিভিন্ন অঞ্চলের গান ও সুর নিয়ে একে অপরের সাথে বাক্য ও ভাব বিনিময় হতো। তৎকালীন সময়ে একজন সাধক বা বাউল আরেকজনের সাথে মিলেমিশে গান রচনা করতো। একজন আরেকজনের সাথে আত্মিক মিলনে আবদ্ধ থাকতো। তারা নিজেদের অভিন্ন সত্তা বলে মনে করতো। রশিদ উদ্দিন সাহেব এবং খালেক দেওয়ান সাহেব দুজন সমসাময়িক ২০ বছরের ছোট বড়। তাদের ভেতর যে সম্পর্কের গভীরতা হৃদয়ের তলদেশকে স্পর্শ করেনি সেটা আমরা সেটা আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি না কিন্তু একটু অনুধাবন করতে পারি যেহেতু তারা দুজনই বাউল সাধক সেহেতু তাদের ভেতর একটি আত্মিক বন্ধন ছিল এটা অনিবার্য হয়তো। তারা বেঁচে থাকলে হয়তো এই বিষয় নিয়ে কোন বিতর্কই হতো না কারণ তারা এই জাগতিক নাম ও নিজস্বতার অনেক উর্ধ্বের মানুষ। তাদের মধ্যে হয়তো ভিন্ন শরীরে অভিন্ন আত্মার যোগসূত্র ছিলো। যেহেতু তারা শ্রদ্ধেয় দুজনই প্রয়াত তাদের কারো সাথে এই বিষয়ে কথা বলার কোন সুযোগ নেই সেক্ষেত্রে এটা আমরা অনুমান করে নিতে পারি যে এক্ষেত্রেও কাকতালীয় ভাবে এমনটাই ঘটেছে হয়তো। খালেক দেওয়ান এবং রশিদ উদ্দিন সাহেব দুজনই আমাদের বাংলার সূফি জগতের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যাদের কাছ থেকে আমরা অনেক অনেক মূল্যবান সংগীত ও জ্ঞানের আলোর সন্ধান পেয়েছি। তারা দুজনই আবহমান বাংলার আকাশে আলোর প্রদীপ স্বরূপ।

কোন বিষয় নিয়ে বিতর্ক করলে সারাদিনই করা যায়। কিন্তু বিতর্কের সমাধানের পথের সন্ধান বেশি জরুরি। কারণ অযথা ও অযাচিত বিতর্কে সমাজ পিছিয়ে যায়। আমরা সংগীত ও সংস্কৃতিতে এমনিতেই দিনে দিনে পিছিয়ে যাচ্ছি। তার ভেতর যদি নিজেদের আত্মিক বন্ধনের জায়গায় এমন ফাটল বা বিচ্ছেদের সূত্রপাত হয় তাহলে আমরা ডুবে যাবো খুব দ্রুতই।

আমি কোক স্টুডিওর গানটি শুনে দেখলাম কোক স্টুডিও খালেক দেওয়ানের ভার্সনটিই করেছে। এখানে কন্ঠ দিয়েছেন একজন আরিফ দেওয়ান এবং অন্যজন শরফুউদ্দিন দেওয়ান ওরেফে সাগর দেওয়ান। গানটির সার্বিক কম্পোজ করেছেন প্রীতম হাসান।

আমাদের এই প্রযুক্তির নতুনত্বের ভিড়ে ধীরে ধীরে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত সকল আঞ্চলিক বিষয়। আমাদের সেই আব্বাস উদ্দিন, বিজয় সরকার, জসিমউদ্দীন, খালেক দেওয়ান, রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, যারা হচ্ছে বাংলার গানের ভুবনের প্রাণ ভ্রমর অথচ তাদের গান এখন আর কেউ শুনে না গায়ও না। কারো মুখে এখন আর এই সকল গান শোনা যায় না। যখন কোন বিষয়ের প্রাকটিস বন্ধ হয়ে যাবে তখন সে বিষয়টিও আমাদের থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে অগ্রসর হবে। তাই অবশ্যই আমাদের সকলকে সম্মিলিত ভাবে কোক স্টুডিওর এই প্রচেষ্টার সাথে সহমত সমেত মানসিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে যাতে গানগুলো আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাওয়ার সুযোগ পায়।

এক্ষেত্রে কোক স্টুডিও এবং প্রীতম হাসান একটি অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারা সম্মিলিত ভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও আঞ্চলিক গানগুলোকে নতুন করে মানুষের মুখে মুখে রটানোর ব্যবস্থা করেছে। আমাদের যে নতুন প্রজন্ম তারা মূলত আমাদের জারি, সারি, বিচ্ছেদ, ভাটিয়ালি, এসব গানের সাথে খুব একটা পরিচিত নয়। আমাদের এই নতুন প্রজন্মকে ঐ সকল গান ও গানের রচয়িতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটাকে আমি সম্মানের সাথে স্বাগত জানাই। এখন তরুণদের মুখে মুখে বেজে উঠছে “মা লো মা” গানটি তারা গাইছে তারা বুঝতে পারছে তাদেরও এমন সংগীতের গুরুত্বপূর্ণ ভান্ডার রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রীতম হাসান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। “মা লো মা” গানটির ভেতর সাগর দেওয়ান নামে প্রয়াত খালেক দেওয়ানের বর্তমান প্রজন্মের একজন কন্ঠ দিয়েছেন। সাগর দেওয়ানের কন্ঠ গানটিকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তার কন্ঠে সুরের যে মনিহার খচিত হীরা বসানো রয়েছে সেটা ঐ গানের ভেতর দিয়ে তার কন্ঠের মুগ্ধতায় ছুয়ে গেছে ভক্তদের হৃদয়। সাগর দেওয়ানের কন্ঠের নাগপাশে আবদ্ধ হয়েছে সকল সংগীত অনুরাগীরা। কোক স্টুডিও এই যে একটি ধারার প্রচলন করেছে যে তারা নতুন ও প্রতিভাবান শিল্পীদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদেরকে নিয়ে কাজ করা এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। এর আগেও আমরা “দেওরা” গানে ইসমাইল উদ্দিন সহ আরো অনেক নিভৃত প্রতিভাকে নিয়ে কোক স্টুডিওকে কাজ করতে দেখেছি যা অবশ্যই কষ্টসাধ্য অনুসন্ধানের ফলেই সম্ভব হয়েছে।

পৃথিবীতে আর যত আনন্দ ও মুগ্ধতার বিষয় রয়েছে তার মধ্যে সংগীত সর্বশেষ্ঠ। সংগীত সম্পর্কে জার্মানি কবি ও দার্শনিক ফেডরিক নিৎসে বলেছেন “আমি যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলি তখন আমি গুন গুন করে গান গাই। গানের মধ্যে ডুবে গিয়ে আমি আবার নিজেকে খুঁজে পাই”

গান সম্পর্কে সাধক রামপ্রসাদ বলেছেন,” গান হচ্ছে এমন সুবাস যা আমাদের সকল প্রাণকে এক অদৃশ্য সুতোয় বেধে রাখে, গান আমাদের সকল প্রাণের অনুভূতির একত্রিত জাগরণ ”

সর্বপরি আমাদের অঞ্চলে কোক স্টুডিও বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী সংগীত ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে টেনে তোলার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টায় ঘাম ঝরাচ্ছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা যে তর্কে জড়িয়ে পড়েছি এই তর্কের আসলে প্রকৃত ও নির্দিষ্ট কোন সমাধান নেই। আমাদের দুই বাউল সাধক পরিবারের উভয়েরই উভয়ের প্রতি সহমর্মিতা সমেত বিষয়টি গ্রহণ করতে হবে। কারণ কপিরাইট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রশিদ উদ্দিনের ‘মাগো মা’ কিংবা খালেক দেওয়ানের ‘মালো মা’—কোনো গানই কপিরাইট অফিসে নিবন্ধন করা নেই। ফলে গানটির মূল স্রষ্টা কে, তা কপিরাইট অফিস সঠিক ভাবে বলতে পারছে না। আবার লোকসংস্কৃতি–গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলেছেন, ‘বাংলা লোকসংগীতের অনেক গান খুবই সমস্যাপূর্ণ। এসব নিয়ে আলাপ করতে গেলে এই নিয়ে অনেক বিতর্ক হবে।

তাহলে এই যখন অবস্থা সেক্ষেত্রে আমাদের সহমর্মিতা সমেত বিষয়টিকে গ্রহণ ছাড়া এই বিতর্ক বা দ্বন্দ্বের কোন সঠিক সমাধানের পথ নেই। এক্ষেত্রে দুপক্ষেরই বিষয়টিকে সহজ ভাবে গ্র্হণ করে এই অযাচিত, অনির্দিষ্ট এবং সমাধানহীন তর্কের অবসান ঘটিয়ে বিষয়টিকে সহজ ভাবে গ্রহণ করে একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করা। সকলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একত্রে সংগীতের এই পুনরুদ্ধারের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী গানের ভুবনকে উজ্জীবিত করবো বলে আশা করি।

কাজী বনফুল: লেখক ও কলামিস্ট।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.