জাবি প্রতিনিধি: বাংলাদেশে বাচ্চারা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ ঘন্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে যা WHO কর্তৃক সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ সময়ের প্রায় ৩ গুন। প্ৰি- স্কুল বাচ্চারা স্মার্টফোন ব্যবহার করে মূলত কার্টুন বা কল্পকাহিনী দেখার জন্য (৭৯%), গেম খেলে জন্য (৪৯%), টেলিভিশন/ভিডিও দেখা বা গান শোনার জন্য (৪৫%), পক্ষান্তরে, শুধুমাত্র (১৪%) অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ নাজমুল হক, সহযোগী অধ্যাপক মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং আর টি এম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ফারুক আব্দুল্লাহ্ এর নেতৃত্বে একটি গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়। গবেষণায় ৪০০ জন প্রি-স্কুল বাচ্চার (৩-৫ বছরের বাচ্চা) মায়েদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা যায়, নির্বাচিত সকল ৩-৫ বছরের বাচ্চাই স্মার্টফোন ব্যবহার করে যাদের মধ্যে ৯২% তাদের পিতামাতার স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং ৮% বাচ্চার ব্যবহারের জন্য পৃথক স্মার্টফোন আছে।
বৈজ্ঞানিকভাবে, স্মার্টফোনের অতিমাত্রায় আসক্তি (প্রোব্লেম্যাটিক স্মার্টফোন ইউস – পিএসইউ) যা নোমোফোবিয়া নামেও পরিচিত বলতে স্মার্টফোনের অনুপস্থিতে বাচ্চাদের অসাভাবিক আচরনকে বুঝায়। মোবাইল ফোনের এই আসক্তি মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ ঘটায়, এর ফলে ব্যবহারকারী ভালো অনুভব করে এবং বেশি সময় ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে উৎসাহিত হয়।
তবে স্মার্টফোনের আসক্তি একটি বহুমাত্ৰীক সমস্যা যা স্মার্টফোনের অনুপস্থিতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার প্রকাশ ঘটায় যেমন, বিষন্নতা, উদ্বেগ, অসামাজিক এবং বিপজ্জনক আচরন ইত্যাদি। এছাড়াও স্মার্টফোনের আসক্তির কারণে বেশ কিছু স্বাস্থ্য এবং আচরণগত সমস্যার উদব্রেগ হতে পারে কারণ এটি তাদের মানসিক, শারীরিক এবং জ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলে। স্মার্টফোনের আসক্তি প্রি-স্কুল বাচ্চাদের জন্য আরো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ক্ষতিকারক হতে পারে।
গবেষণায় আরো দেখা যায়, প্রায় ৮৬% প্রি-স্কুল বাচ্চারা স্মার্টফোনে আসক্ত যার মধ্যে ২৯% এর মারাত্তকভাবে স্মার্টফোনের আসক্তি রয়েছে। কিন্তু প্রতি ১০ জন মায়ের মধ্যে ৪ জনই স্মার্টফোনের আসক্তি সম্পর্কে অবগত নন। বাংলাদেশের প্রি-স্কুল বাচ্চারা স্মার্টফোনের আসক্তিতে ভুগছে মূলত বাবা-মা সন্তান্দেরকে সময় কম দেওয়ার কারনে (৮৫%), এছাড়াও খেলার মাঠের (৫২%) ও খেলার সাথীর (৪২%) অভাবে বাচ্চারা স্মার্টফোনের দিকে আসক্ত হচ্ছে।
জরিপে, অবিভাবকরা কেন সন্তানদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেন এই প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশ (৭৩%) মা বলেছেন যে তারা তাদের বাচ্চাদের স্মার্টফোনের সাথে ব্যস্ত রাখতে চান যাতে তারা তাদের কাজ বিনা বাধায় করতে পারেন, (৭০%) মা তাদের বাচ্চাদের স্মার্টফোন দেন কারণ তাদের বাচ্চারা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পছন্দ করে, (৬৭%) মা তাদের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য এবং (৩১%) মা শিশুকে ঘুম পারানোর জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, মা ও বাবার প্রতিদিনের স্মার্টফোনের ব্যবহারের মাত্রাও তাদের সন্তান্দেরকে স্মার্টফোনে আসক্ত করতে উদবুদ্ধ করে। কেননা যেসব মা ও বাবা প্রতিদিন ৩ ঘন্টা বা তার বেশি সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের সন্তানরা স্মার্টফোনে আসক্ত হওয়ার সম্ভবনা প্রায় ৯০ গুণেরও বেশি। তদুপরি, পেশাজীবী মায়ের বাচ্চারা অধিকহারে স্মার্টফোন আসক্তিতে ভুগছে কেননা তারা তাদের সন্তানদেরকে প্রয়োজন অনুসারে সময় দিতে পারছেন না। পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থানও প্রি-স্কুল বাচ্চাদের স্মার্টফোনে আসক্তিতে গুরুত্তপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
গবেষণায় আরো দেখা যায়, অধিক আয়ের পরিবারের (মাসিক ২৫০০০ টাকা বা তার বেশি) বাচ্চারা অধিক হারে স্মার্টফোনে আসক্ত।
স্মার্টফোনের আসক্তি প্রি-স্কুল বাচ্চাদের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং জ্ঞান বিকাশে কি কি ধরনের ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে তা অনুসন্ধান করে দেখা যে, স্মার্টফোনের আসক্তিতে বাচ্চাদের বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হয় যেমন ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন, কারণ ছাড়াই রেগে যাওয়া, অপর্যাপ্ত এবং অনিয়মিত ঘুম, অমনযোগীতা, ভুলে যাওয়া, ভাষার দক্ষতা বিকাশ না হওয়া এবং ভাইবোন, পিতামাতা ও খেলার সাথীদের সাথে বিছিন্নতা। একই সাথে বিভিন্ন রকম শারিরীক সমস্যার কথাও উঠে এসেছে যেমন স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চারা সচরাচর মাথাব্যথা, হাত ও পিঠে ব্যথা, ক্ষুধা হ্রাস, অনিয়মিত খাবারের সময়, ওজন এবং উচ্চতার অসামঞ্জস্যপূর্ণতা এবং শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় ভুগছে। এখানে উল্লেখ্য যে, স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চারা স্মার্টফোনে আসক্ত নয় এমন বাচ্চাদের তুলনায় মারাত্তক হারে (৫০০ গুণ) মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুকিতে আছে। একই সাথে স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চাদের শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুকিও কম নয় যা স্মার্টফোনে আসক্ত নয় এমন বাচ্চাদের তুলনায় ২৩০ গুণ বেশি। কিন্তু মজার ব্যপার হলো প্রতি ১০ জনে ৫ জন মা-ই বিশ্বাস করেন যে তাদের সন্তান স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনেক কিছুই শিখতে পারে।
গবেষকদলের অভিভাবকদের প্রতি পরামর্শ, তাদের প্রি-স্কুল সন্তানদের প্রস্তাবিত সময়ের বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে না দেওয়া, তাদের সাথে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করা এবং তাদের খেলার পরিবেশ ও খেলার সাথী নিশ্চিত করা যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্মার্টফোনের আসক্তির বিরুপ প্রভাব থেকে রক্ষা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
গবেষকদল আরো মনে করেন যে, সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অতিমাত্রায় স্মার্টফোন আসক্তির বিরুপ প্রভাব সম্পর্কে সন্তানদের বাবা-মায়েদেরকে সতর্ক করতে পারে। এ বিষয়ে একটি জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা হওয়া প্রয়োজন এবং তার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে প্রি-স্কুল বাচ্চাদের স্মার্টফোন ব্যবহারের জন্য একটি নির্দেশানাবলী তৈরী করে সেই অনুযায়ী কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করা প্রয়োজন। অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে সুস্থ্য ও সৃজনশীল রাখা অসম্ভব হয়ে পরবে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ নাজমুল হক বলেন, স্মার্টফোনের আসক্তি শিশুদের মানসিক, শারীরিক এবং জ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ বিষয়ে আমাদের আগে থেকেই যথেষ্ট সচেতন হওয়া উচিত। প্রি-স্কুল বাচ্চাদেরকে প্রস্তাবিত সময়ের বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে না দেওয়া, তাদের সাথে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করা এবং তাদের খেলার সাথী ও পরিবেশ নিশ্চিত করা ইত্যাদি আগামী প্রজন্মকে স্মার্টফোনের বিরুপ প্রভাব থেকে দূরে রাখবে।
উল্লেখ্য, গবেষণার মূল প্রবন্ধটি এলসভিয়ারের জার্নাল অব এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার নামক একটি প্রথম শ্রেনীর জার্নালের ৩২৯ নং ভলিউমে প্রকাশিত হয়েছে।