The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪

আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করলেন তসলিমা নাসরিন

অসুস্থ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখিকা তসলিমা নাসরিন। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিছুদিন আগেই বেসরকারি হাসপাতালের বেডে তাঁর বিশ্রাম নেওয়ার ছবি ভাইরাল হয়। কী হয়েছে তসলিমার? প্রশ্ন করতে শুরু করেছিলেন অনেকেই। এবার নিজের অসুস্থতা সম্পর্কে ধারণা দিলেন তিনি। করলেন ভয়াবহ অভিযোগ।

লেখিকার কথায়, হাসপাতালের বেডে আমার শুয়ে থাকার ছবি দেখে অনেকে ভেবেছে আমার বোধহয় হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়েছে। না, সেসব কিছুই হয়নি। সেদিন ওভারসাইজ পাজামা পরে হাঁটছিলাম ঘরে, পাজামা চপ্পলে আটকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। অগত্যা যা করতে হয়, করেছি। হাঁটুতে ব্যথা হচ্ছিল, আইস্প্যাক দিয়েছি, ভলিনি স্প্রে করেছি। মনে হল হাঁটুর লিগামেন্টে হয়তো লেগেছে, কোনও হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে করে দেখি কী হলো। গেলাম হাসপাতালে। এক্সরে আর সিটিস্ক্যান করে হাড়ের ডাক্তার বলে দিলেন পায়ের ফিমার নামের হাড়টির গলায় একখানা ক্র্যাক হয়েছে। এর চিকিৎসা কী, চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দুটো অপশান দিলেন, প্রথম অপশান ইন্টারনাল ফিক্সেশান, ফাটলের জায়গাটা স্ক্রু লাগিয়ে ফিক্স করে দেবেন। দ্বিতীয় অপশান হিপ রিপ্লেসমেন্ট, আমার হিপ কেটে ফেলে দিয়ে কিছু প্লাস্টিক মেটাল দিয়ে একটা নকল হিপ বানিয়ে দেবে্ন। কিন্তু ইন্টারনাল ফিক্সেশান এর বিপক্ষে অজস্র বাজে কথা, এবং হিপ রিপ্লেসমেন্টের পক্ষে অজস্র ভালো কথা বললেন আমার কানের কাছে।

আমি তারপরও প্রথম অপশানই নেবো, যেটিকে সত্যিকারের ট্রিট্মেন্ট বলে জানি। জোর দিয়ে বললাম, ফিক্সেশান করবো। ডাক্তার খুশি হলেন না ততটা। বললেন ফিক্সেশানে সবসময় ফিক্স হয় না, ৮০% কাজ হয়, কিন্তু ২০ % ফেইল করে। আমি বল্লাম, ‘দেখা তো যাক ফিক্স হয় কিনা, হয়তো হবে।’ সার্জন বললেন, ‘ফিক্স না হলে কিন্তু আবার অপারেশান করতে হবে, আবার ওই হিপ রিপ্লেসমেন্টেই যেতে হবে।’ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলাম। সকালে অপারেশান, আমাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হবে, ফিক্সেশান করা হবে।

আচমকা সার্জন এসে বললেন, ‘শুনুন, হিপ রিপ্লেসমেন্ট ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। করলে ওটাই করবো। একটুও ভাব্বেন না রিপ্লেসমেন্টের পরদিনই আপনি হেঁটে বাড়ি চলে যেতে পারবেন।’ আমি সেকেন্ড অপিনিয়নের জন্য সময় চাইলাম। সার্জন খুশি হলেন না। বললেন, অপারেশান এক্ষুনি না করলে প্রব্লেম, ইনফেকশান হয়ে যাবে, এটা সেটা। হাসপাতালের অন্য দুজন ডাক্তার যাঁদের আমি চিনতাম, তাঁরাও আমাকে চাপ দিলেন সার্জনের উপদেশ মেনে নিতে, কারণ উনি ‘অনেক ‘বড় সার্জন’। অগত্যা আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে রাজি হতে বাধ্য হতে হলো। তারপর কী হলো, আমার হিপ জয়েন্ট কেটে ফেলে দিয়ে টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট করা হলো। একটা পঙ্গু মানুষের জীবন আমাকে দেওয়া হলো।

চেতন ফিরলে ব্যাপারটার আরও ভেতরে গিয়ে দেখলাম, যাদের হিপ জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা, বছরের পর বছর হাঁটতে বা চলতে ফিরতে পারে না, হিপ জয়েন্ট যাদের স্টিফ হয়ে গেছে জয়েন্টের রোগে, রিউমাটয়েড আর্থাইটিস, জয়েন্টে টিউমার বা ক্যান্সার–তাদের, সেই অতি বয়স্ক মানুষদের, টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট করা হয়, কিছুদিন জয়েন্টের যন্ত্রণা কমিয়ে হাঁটা চলা করতে যেন পারে। আমি ছিলাম এক্সারসাইজ করা প্রচণ্ড অ্যাক্টিভ মানুষ, সাইক্লিং, সুইমিং, ট্রেড মিল করছি, দৌড়োচ্ছি। শরীর থেকে ডায়বেটিস, ব্লাড প্রেশার, ফাইব্রোসিস উবে গেছে। সেই আমাকে সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে, চিন্তার কিছু নেই, তুমি হাঁটতে পারবে। ফাঁকে এও বলে দেওয়া হলো তবে, কোমোডে বসতে পারবে না, উবু হতে পারবে না, পায়ের ওপর পা রাখতে পারবে না, ওজন বহন করতে পারবে না, নরমাল চেয়ারে বসতে পারবে না, এরকম হাজারো রেস্ট্রিকশান। এ কেমন জীবন আমাকে দেওয়া হলো! এই পঙ্গু জীবন পেতে কি আমি প্রাইভেট হাসপাতালে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করতে এসেছিলাম!

যখন বুঝলাম ডাক্তার ভীষণ অন্যায় করেছেন, আমাকে ভুল কথা বলে, ভয় দেখিয়ে আমার হিপ কেটে নিয়েছেন, আমি জিজ্ঞেস করেছি, যে কারণে হিপ রিপ্লেসমেন্ট করা হয়, তার একটি রোগও আমার ছিল না, আমার জয়েন্টে কোনও ব্যথা ছিল না, কোনও আরথ্রাইটিস ছিল না, নেক ফিমারের ফিক্সেশান করতে গিয়ে হিপ জয়েন্ট কেটে কেন ফেলে দিলেন? বললেন তাঁর নাকি মনে হয়েছে ফিক্সেশান কাজ করবে না। একবার ট্রাই করে দেখা উচিত ছিল না? তাঁর উত্তর, ফিক্সড না হলে আবার অপারেশান করতে হতো, সেই ঝামেলায় না গিয়ে পরে যেটা করতে হবে, সেটা আগেই করে দিলাম। আমেরিকানরা অল্প অল্প করে এগোয়, আমরা একটু এগ্রেসিভ, আমরা আগেই শেষটা করে দিই। কিন্তু অপারেশানের দিন তো বললেন, অন্য কোনও অপশান নেই হিপ রিপ্লেসমেন্ট ছাড়া!
উত্তর নেই।

উপদেশ এলো, আমি যেন একটু পজিটিভ হই। পঙ্গু জীবন নিয়ে ঠিক কী করে পজিটিভ হওয়া যায়, সেটা বুঝতে পারছি না।

আমার কাছে মনে হচ্ছে, একটুও বাড়িয়ে বলছি না, মাথায় ব্যথা পেয়ে এসেছিলাম চিকিৎসার জন্য, আমার মাথাটা কেটে নেওয়া হয়েছে। সার্জনদের যুক্তি হলো, মাথা ফেলে দিলে মাথা ব্যথা করবে না।

প্রাইভেট হাসপাতালের টারগেট মার্কেটের শিকার হলাম। লেখক এবং ডাক্তার হিসেবে হাসপাতালে আমার নাম লেখা হয়নি। ‘বাংলাদেশি রোগী’ হিসেবে লেখা হয়েছে।

দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টের একেবারে শেষে তিনি বললেন, “আমেরিকানরা অল্প অল্প করে এগোয়। আমরা একটু অ্যাগ্রেসিভ। আমরা আগেই শেষ যেটা করতে হয় সেটা করে দিই।” চিকিৎসক নাকি তাঁকে পজিটিভ থাকতে বলেছেন। লেখিকার আফসোস, “পঙ্গু জীবন নিয়ে ঠিক কী করে পজিটিভ হওয়া যায়, সেটা বুঝতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, মাথায় ব্যথা পেয়ে এসেছিলাম চিকিৎসার জন্য। আমার মাথাটা কেটে নেওয়া হয়েছে। সার্জনদের যুক্তি হল, মাথা না থাকলে ব্যথাও করবে না।”

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.