আলীহোসাইন আকবরআলী। তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের ইস্পাতশিল্পের গুরু। বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলের (বিএসআরএম) চেয়ারম্যান। এ দেশের লৌহ ও ইস্পাতশিল্পের যুগান্তকারী সব পরিবর্তনই এসেছে তাঁর হাত ধরেই। তিনি শুনিয়েছেন তাঁর জীবনের গল্প, বলেছেন সাফল্যের পেছনের কথা।
সবে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি শেষ করেছেন। হাতে ছিল সৌদি আরবের সরকারি তেল কোম্পানি আরামকোতে উচ্চ বেতনের চাকরির অফার। পরিবারের ব্যবসা তখন ইস্পাত খাতে। ব্যবসা না চাকরি, কোনটাতে থিতু হবেন-এই চিন্তায় শেষমেশ পরামর্শ চাইলেন বাবার কাছে। বাবা জীবনের চাবি তুলে দিলেন তার হাতে, ‘তুমি জীবনের যে কোনো সময় চাইলে অ্যাকাউনট্যান্ট হতে পারবে, তবে ব্যবসায় থাকলে যে অভিজ্ঞতা হবে, তা জীবনে কখনো অর্জন করতে পারবে না।’
বাবার এই কথায় ১৯৭২ সালে মাসিক ২৫ হাজার রুপির চাকরির প্রস্তাব ফেলে আলীহোসাইন আকবরআলী যোগ দিয়েছিলেন পারিবারিক ব্যবসায়। শুধু যোগই দেননি, নিজের অক্লান্ত শ্রমে বাবা-চাচাদের হাতে গড়া ইস্পাত কারখানাকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়। হিসাববিদ্যায় পড়াশোনা করেও এ দেশের প্রকৌশল খাতের প্রতিষ্ঠান ইস্পাতশিল্পের গুরু হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন।
বাংলাদেশে এখন এমন কোনো বড় ধরনের প্রকল্প নেই যেখানে বিএসআরএমের রড ব্যবহার হচ্ছে না। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, উড়ালসড়ক, কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে বিএসআরএমের রড।
এ দেশে ইস্পাতের ইতিহাস শুরু হয়েছে আজ থেকে ৬৮ বছর আগে, ১৯৫২ সালে। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার কারখানায় আজকের বিএসআরএম গ্রুপের যাত্রা শুরুর সময়টাও একই। এই খাতে প্রথমে নেতৃত্ব দেন তাঁর বাবা আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালা। এরপর হাল ধরেন তিনি। এই সোনালি সময়টাও প্রায় ৪৩ বছরের।
বিএসআরএমের শুরুর গল্পঃ
দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে রড তৈরির কোনো কারখানা ছিল না। এ সময় বাংলার ১৮টি কারখানাই পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। তখনই চট্টগ্রামে ইস্পাতের মতো মাতৃশিল্প নির্মাণের পরিকল্পনা মাথায় আসে তাঁর বাবার। তাঁর চাচা তাহেরালী আফ্রিকাওয়ালা গেলেন কলকাতায়। কারখানা নির্মাণের জন্য কলকাতা থেকে একজন দক্ষ কারিগর আনা হলো। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা হলো দক্ষ শ্রমিক। ১৯৫২ সালে নাসিরাবাদে নির্মাণ হলো রড তৈরির কারখানা ‘ইস্ট বেঙ্গল রি-রোলিং মিলস’। ইস্পাত শিল্পের ইতিহাসও শুরু হলো।
ষাটের দশকে (১৯৫২-৫৯) চারটি কারখানা তাঁদের পরিবারের হাতে আসে। রাশিয়ান লেখক এস এস বারানভ ‘পূর্ববাংলা: অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ষাটের দশকের শেষদিকে সম্প্রদায়ভিত্তিক যে বৃহৎ শিল্পপতি পরিবার ছিল, আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালা পরিবার তাদের অন্যতম।
চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠাঃ
ইস্পাত কারখানা চালুর তিন বছর আগে ভারতের গুজরাটের আম্রেলি জেলায় জন্ম হয় আলীহোসাইন আকবরআলীর। গুজরাটে জন্ম হলেও স্কুল-কলেজের পড়াশোনা চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় সেন্ট প্লাসিডস স্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। আগ্রাবাদের সরকারি কমার্স কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন। উচ্চমাধ্যমিকে কুমিল্লা বোর্ডে মেধাতালিকায় নবম স্থান অধিকার করেন তিনি।
এরপর পাকিস্তানের করাচি চলে যান। সেখানে এসএম কলেজে সন্ধ্যাকালীন বিকম কোর্সে ভর্তি হন। আর দিনে করাচিতে এএফ ফারগুসানে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্সি (সিএ) কোর্স করেন। ১৯৭২ সালেই কোর্স শেষ করেন। আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালার তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট তিনি।
নতুন করে শুরুঃ
উচ্চ বেতনের চাকরির প্রস্তাব পেয়েও গেলেন না সৌদি আরবে। বাবার অনুপ্রেরণায় করাচিতে চাচার সঙ্গে ইস্পাত পণ্যের ব্যবসায় যুক্ত হন। অভিজ্ঞতা অর্জনের পর ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম ফিরে বিএসআরএম কারখানায় যোগ দেন।
আলীহোসাইন আকবরআলী বলেন, ‘বাবা সব সময় বলতেন, বিশ্বের যেকোনো দেশে যেতে পারো, কিন্তু চট্টগ্রামের মতো শান্তি বিশ্বের কোথাও পাবে না। এখানে সংস্কৃতির সমস্যা নেই। লোকজন ভদ্র। ধার্মিক। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে বিনিয়োগের জন্য সবই আছে।’
কারখানায় যোগ দিয়ে তিনি দেখলেন, ইস্পাত খাতে বিনিয়োগের জন্য বন্দর সুবিধা, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি-সবই আছে চট্টগ্রামে। শুরু হলো বাবার সঙ্গে কারখানায় অভিজ্ঞতা নেওয়ার পালা। খুব দ্রুত দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। ১৯৮৫ সালের মধ্যে পুরো দায়িত্বভার তাঁর হাতে তুলে দেন বাবা। তবু বাবাকে চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে রেখেই ইস্পাতশিল্পের মান উন্নয়নে নজর দেন।
যেভাবে সাফল্যঃ
নব্বই দশক ছিল ইস্পাতশিল্পের জোয়ার। লাইসেন্স প্রথা তুলে দেওয়া হয়। বহু উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করেন। রডের কাঁচামাল সহজলভ্য করে জাহাজ ভাঙার পুরোনো লোহা। ঠিক এ সময়ই শক্তিশালী রড নির্মাণের জন্য যুক্তরাজ্য থেকে আনা হয় কারখানার যন্ত্রপাতি। ১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশক্তির ৬০ গ্রেড রড তৈরি শুরু হয় তাঁর হাত ধরে।
এক যুগ আগে নির্মাণশিল্পে জোয়ার শুরু হয়। আবাসন খাতের উত্থান ঘটে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে। এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না আলীহোসাইন। ইতালি থেকে নিয়ে এলেন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি।
আলীহোসাইন বলেন, ‘৪০ গ্রেডের তুলনায় ৬০ গ্রেড রড ব্যবহার করা হলে ৩০ শতাংশ রড সাশ্রয় হয়। নির্মাণশিল্পে এটা বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে সে সময়। যুক্তরাজ্যের যন্ত্র দিয়েই ২০ বছর ধরে ৬০ গ্রেডের রড উৎপাদন করি। ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। অন্যরাও শুরু করে।’
দেশে উৎপাদিত রড বিশ্বমানের-এটা সবারই জানা। প্রতিবেশী ভারতের রডের মানের তুলনায় আমাদের এখানে মান কেমন? আলীহোসাইন জানালেন, ‘বিএসআরএমের রডের মান ভারতের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত কোম্পানিগুলোর মতো একই। দেশীয় আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেরও এ সক্ষমতা আছে।’
বলে রাখা ভালো, আন্তর্জাতিক মানের সক্ষমতার বহু সনদ অর্জন করেছে বিএসআরএমের রড। রপ্তানি হচ্ছে ভারতের ত্রিপুরায়ও।
সাদামাটা জীবনঃ
এত সাফল্য যাঁর হাতে, তাঁর পারিবারিক জীবনই-বা কেমন? সেসব কথা অকপটে বলে গেলেন তিনি। জানালেন, বড় ছেলে আমীর আলীহোসাইন পড়াশোনা শেষ করে ২০০০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। এক মেয়ে হংকং এবং দুই মেয়ে পাকিস্তানে বসবাস করছেন। নাতি-নাতনির সংখ্যা এখন ১০ জন।
এখনো খুব সহজ সরল জীবন যাপন করেন তিনি। আড়ম্বরপূর্ণ ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবন পছন্দ করেন না। অহংকার নেই। সময় কাটাতে পছন্দ করেন পরিবারের সদস্য ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তার কাছে সব সময় ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমাদের যা দিয়েছেন, সে জন্য সৃষ্টিকর্তাকে সব সময় কৃতজ্ঞতা জানাই। এটাই আমাদের জীবনকে সঠিক পথে রাখার সেরা উপায়।’
তাঁর প্রিয় শখ মানুষের জন্য কাজ করা। এখনো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনার জন্য নাসিরাবাদে কারখানার পেছনে স্কুল গড়ে তুলেছেন। সেখানে ৫৫০ জন ছেলেমেয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করছে। যারা মেধাবী, তাদের পরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ার দায়িত্ব নেন। আবার যশোরে গরিব মেয়েদের জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু করেছেন। এসব কাজেই তৃপ্তি পান বলে জানালেন।
তরুণদের প্রতি পরামর্শঃ
আলীহোসাইন মনে করেন, সাফল্য পাওয়ার কোনো ছোটখাটো পথ নেই। তিনি বলেন, প্রথমদিকে অভিজ্ঞতা নেওয়া হলো জরুরি। চাকরি হোক আর ব্যবসা হোক, অভিজ্ঞতা নিতে হবে আগে। পছন্দ বা অপছন্দে শুরুতে জোর দেওয়া উচিত নয়। অন্য কাউকে দেখে হতাশ হলে চলবে না। লোভ করা যাবে না। অবশ্যই চাকরি থেকে ব্যবসা ভালো। উদ্যোক্তা হওয়া ভালো। সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে আগে।
নিজের লিংকডইন প্রোফাইলেও তুলে ধরেছেন জীবন দর্শনের কথা, ‘সাফল্যের কোনো সহজ পথ নেই; কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই।’