মারুফ হোসেন মিশন, রাবি: ৭৫৩ একর মতিহারের সবুজ চত্বরে বেষ্টিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত আন্দোলন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক এই বিশ্ববিদ্যালয়। চল্লিশ সহস্রাধিক প্রাণের চাঞ্চল্যে গমগম করে ওঠা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পঠনে সীমাবদ্ধ থাকেনি, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সংগ্রামে বুক পেতে দিয়ে এগিয়ে চলছে। ছায়াশীতল এই ক্যাম্পাস তাই আমাদের মাতৃতুল্য।
বিভিন্ন সময়ে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ‘৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬-এর ছয় দফা, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ‘৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে রাবির শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্র-শিক্ষক ঝাঁপিয়ে পড়েছে অত্যাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে। ষাটের দশকের শেষ দিকে এই ভূখণ্ড যখন গণআন্দোলনে উত্তাল, তখন রাবির শিক্ষার্থীরাও স্বাধিকার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় রয়েছে দেশের ঐতিহাসিক কিছু নান্দনিক স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, প্রথম জাদুঘরখ্যাত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, শহীদ মিনার, রয়েছে শিল্পী নিতুন কুণ্ডের অমর কীর্তি মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘সাবাশ বাংলাদেশ’। বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা নামক একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী সুউচ্চ মেটালিক টাওয়ার, বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য বিদ্যার্ঘ্য, ড. জোহার প্রতিকৃতি ও বিজয় সাগর। এসব নান্দনিক স্থাপনা দৃষ্টিকারী দেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ও এখানে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থীদের। রাবির ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
শহীদ মিনার কমপ্লেক্স:
এখানে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও দেশের ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধাভিত্তিক প্রথম শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, দুটি মুরাল ও উন্মুক্ত মঞ্চ। এটি একটি ওয়াই ফাই জোন। শহীদ মিনারের দক্ষিণ পার্শ্বেই অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ। মোঘল স্থাপত্যশিল্পে নির্মিত হয়েছে এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি।
সাবাশ বাংলাদেশ:
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক এই ভাস্কর্যটি সিনেট ভবনের দক্ষিণ চত্বরে অবস্থিত। শিল্পী নিতুন কুন্ডুর শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় লাল বেলে মাটি দিয়ে ১৯৯১ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সংগ্রামী বাঙালির ইতিহাস ও অসাম্প্রদায়িক বাংলার চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতিফলন এ ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যের পাদদেশে একটি মুক্ত মঞ্চ আছে। ৬ ফুট বেদীর উপর স্থাপিত মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া দুজন তরুণের ছবি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে তরুণদের অবদানের কথা। ভাস্কর্যটির দু’পাশে আয়তাকার দুইটি দেয়ালের একটিতে কয়েকজন বাউল একতারা বাজিয়ে গান করছে। যা বাঙালী জাতির গ্রামীণ সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে। অন্যটিতে মায়ের কোলে শিশু ও দুইজন তরুণী, একজনের হাতে রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। তার দিকে অবাক তাকিয়ে আছে এক কিশোর।
সুবর্ণ জয়ন্তী টাওয়ার:
বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তিকে স্মৃতির মণিকোঠায় ধরে রাখার জন্য ২০০৩ সালে নির্মাণ করা হয় নান্দনিক এই স্থাপনাটি। প্রধান ফটক পেরিয়ে সড়ক দ্বীপের ডানে, প্রশাসন ভবনের সামনে জোহা চত্বরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। রাজশাহীর সন্তান প্রথিতযশা ভাস্কর মৃণাল হকের সুনিপুণ কারুকার্যে তৈরি হয় এই নান্দনিক স্থাপনাটি। স্টিলের তৈরি ৩৫ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট পৃথিবীর অন্যতম অত্যাধুনিক এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তবে অবহেলা আর অযত্নে নষ্ট হতে বসেছে অপরূপ সৌন্দর্যের এই স্থাপনাটি।
বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ:
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলের প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে এই স্মৃতিস্তম্ভটি অবস্থিত। ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল আবিষ্কৃত হয় এখানকার গণকবরগুলো। প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা জায়গাটি ছোট হলেও এখানে ৮-১০টি গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে এবং ধারণা করা হয় এই গণকবরগুলোতে প্রায় ৩-৪ হাজার নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ৬ স্তরবিশিষ্ট এ স্মৃতি স্তম্ভটি সমতল ভূমি হতে ৪২ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। স্তম্ভটির চারপাশ ঘিরে আছে গোলাকার একটি কংক্রিটের বেদি এবং বেদির মাঝখানে আছে বড় একটি কূপ। কূপটিকে ‘মৃত্যুকূপ’ এর সঙ্গে তুলনা করা হয়। স্তম্ভের গায়ের কালো কালো ছাপ যা দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখা শহীদদের রক্ত শুকানো দাগের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। স্তম্ভের ভাঙা ইট দ্বারা মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের ক্ষত বোঝানো হয়েছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক:
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের কাছে ৬১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই ফলকটি নির্মাণ করা হয়। ২৬ ফুট দৈর্ঘ্য এবং সাত ফুট প্রস্থের কালো মার্বেল পাথরের বেদির উপরে স্থাপিত স্মৃতিফলকের প্রধান অংশ সাদা দেয়াল। সাদা দেয়ালের পেছনের অংশের দেয়ালে খোদাই করা হয়েছে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ’৬২-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের মৃত্যু, দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যু, এগারো দফা ও ’৭০-এর নির্বাচনের বিভিন্ন চিত্র। সামনের দেয়ালের বাম পাশের উপরের দিকে ফুটিয়ে তোলা হয় মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তিন শিক্ষক ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, শহীদ ড. হবিবুর রহমান ও মীর আব্দুল কাইয়ূমের প্রতিকৃতি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণের প্রতিকৃতি স্মৃতিফলকের সামনের দেয়ালের নিচের দিকে স্থাপন করায় আছে অনেক সমালোচনা।
শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা:
এটি বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বরের পূর্বপাশে অবস্থিত। এতে স্থান পেয়েছে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন চিত্রকর্ম, দলিল-দস্তাবেজ, আলোকচিত্র, জামা, জোব্বা, কোট, ঘড়ি, পোশাক, টুপি, কলমসহ বিভিন্ন দুর্লভ সংগ্রহ। রাজশাহীতে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের বাঁধাইকরা আলোকচিত্র, আমতলার সভা, কালো পতাকা উত্তোলন ও মিছিল, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি, ’৬৯-এর গণবিক্ষোভের মুখে পুলিশ বাহিনী, শহীদ আসাদ, শহীদ মতিউর, শহীদ রফিক, শহীদ বরকত, শহীদ সালাম ও শহীদ শামসুজ্জোহার প্রতিকৃতি, গুলিবিদ্ধ-হাসপাতালে মৃত-কফিনে শায়িত ড. জোহার ছবি। আছে জাতীয় চার নেতা এবং রাবির শহীদ শিক্ষকদের প্রতিকৃতি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা-বাণীর প্রতিলিপি, মুজিবনগরে ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র, ’৭১-এর ছাত্রী নিগ্রহ, গণহত্যা, পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলের চুক্তিপত্র, মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত পোস্টার, শহীদদের পোশাক ও ব্যবহৃত জিনিসপত্রসহ আরো অনেক কিছু।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর:
এই জাদুঘরটি রাজশাহী শহরে স্থাপিত বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। এই প্রত্ন সংগ্রহশালাটি ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এটি পরিচালনা করে থাকে। বরেন্দ্র জাদুঘরে প্রায় ৯ হাজারেরও অধিক নিদর্শন রয়েছে। জাদুঘরের সংগ্রহশালায় রয়েছে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন, মহেনজোদারো সভ্যতার প্রত্নতত্ত, পাথরের মূর্তি, একাদশ শতকে নির্মিত বুদ্ধ মূর্তি, ভৈরবের মাথা, গঙ্গা মূর্তি, মোঘল আমলের রৌপ্র মুদ্রা, গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গোলাকার রৌপ্য মুদ্রা বিশেষ ভাবে উল্যেখয়োগ্য। এখানে প্রায় ৫,০০০ পুঁথি রয়েছে যার মধ্যে ৩৬৪৬টি সংস্কৃত আর বাকিগুলো বাংলায় রচিত। পাল যুগ থেকে মুসলিম যুগ পযর্ন্ত সময় পরিধিতে অঙ্কিত চিত্রকর্ম, নূরজাহানের পিতা ইমাদ উদ দৌলার অঙ্কিত চিত্র এখানে রয়েছে।
বিদ্যার্ঘ:
মুক্তিযুদ্ধকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক শহীদ হবিবুর রহমানের স্মরনে ২০১১ সালে সৌধটি নির্মিত হয়। এটি শহীদ হবিবুর রহমান হল চত্বরে অবস্থিত। ভাস্কর্যটির স্থপতি শিল্পী শাওন সগীর সাগর। প্রায় ৫ ফিট দৈর্ঘের দু’জন মুক্তিযোদ্ধা সগর্বে দাঁড়িয়ে আছেন। একজনের হাতে বন্দুক এবং অন্যজনের হাতে কলম। বন্দুকের চেয়ে কলম বড় সেটা বোঝাতে কলমটি বন্দুকের চেয়ে উপরে রাখা হয়েছে। ভাস্কর্যটি একটি ষষ্ঠভূজের উপর নির্মিত। কালো রংয়ের ষষ্ঠভূজটিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গ্রন্থটির ঠিক উপরে রয়েছে একটি সূর্য- যা বাঙালি জাতিকে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি দিয়ে যাচ্ছে। সূর্যের মাঝখানে লেখা বিদ্যার্ঘ শব্দটি জ্ঞানের আলোকে বোঝানো হয়েছে।
স্ফুলিঙ্গ:
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা স্মরণে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কনক কুমার পাঠক ২০১২ সালে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন। এই ভাস্কর্যে শহীদ শামসুজ্জোহার ৩ ফুট উচ্চ আবক্ষ প্রতিকৃতি রয়েছে। বেদির ঠিক পেছনে রয়েছে বাঁকা লম্বা একটি দেয়াল। দেয়ালটি লাল আর কালো ইটের দ্বারা তৈরি। আর দেয়ালের মাঝখানে রয়েছে গোল বৃত্ত। একপাশ থেকে দেখলে বোঝা যায় বাঁকা দেয়াল দ্বারা উড়ন্ত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে নির্দেশ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি:
দেশের অন্যতম দ্বিতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরী এটি। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ একাডেমিক ভবনের পূর্ব পাশে এটির অবস্থান। লাইব্রেরিতে আছে ৩৫ হাজারের অধিক বই, ৪০ হাজারের বেশি গবেষণা পত্রিকা ও সাময়িকি। প্রতিদিন সকাল ৯টা ১৫ মিনিট থেকে রাত ৮টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকে লাইব্রেরিটি। জার্নাল রুম, রেফারেন্স শাখা ও সাধারণ পাঠকক্ষ এবং বিজ্ঞান পাঠকক্ষ মিলে প্রায় ৭৫০টি আসন আছে লাইব্রেরিতে।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের পশ্চিম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওয়েবসাইট’ ভাস্কর্য’ (ru.ac.bd), ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা এবং স্যার জগদীশচন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের ঠিক মাঝে একটি ‘কিউব’ ভাস্কর্য, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ‘বইয়ের স্তুপ’ ও শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সিনেট ভবনের সামনে একটি ‘বই’ এর ভাস্কর্য রয়েছে, যা উন্নত বিদ্যাপীঠের প্রতীকী রূপ।