আবারও কওমি মাদ্রাসাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার আলোচনা উঠেছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে সরকারের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, দেশের সবগুলো মাদ্রাসাকে এক বোর্ডের অধীনে আনার বিষয়টি পর্যালোচনাধীন। তবে, যাদের ঘিরে এই পর্যালোচনা, তারাই এ বিষয়ে অন্ধকারে রয়েছেন।
বিভিন্ন বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সরকারের এ উদ্যোগ সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না।
গত ২৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসাগুলোকে একটি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করা প্রয়োজন। কওমি মাদ্রাসাসহ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর করা এবং সরকারি নিবন্ধনের আওতায় আনার প্রয়োজন রয়েছে। এ লক্ষ্যে সমন্বিত একটি নীতিমালা এবং কওমি মাদ্রাসা সংক্রান্ত বর্তমানে আলাদাভাবে পরিচালিত ছয়টি বোর্ডকে সমন্বিত করে একটি কমিটি গঠনের বিষয়টি সরকারের পর্যালোচনাধীন।’
শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য ধরে সঙ্গে কথা বলেন কওমি মাদ্রাসার কয়েকজন দায়িত্বশীল আলেম। তারা বলেন, সরকার কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে চার বছরেরও বেশি হলো। এখন নতুন করে আবার নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন কেন? উপরন্তু এক বোর্ডের অধীনেই দেশের সব মাদ্রাসা পরীক্ষা দিচ্ছে দাওরায়ে হাদিস স্তরে। সেক্ষেত্রে নতুন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে (‘আল-হাইআতুল উলয়া লি-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ) জানানো রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে পড়ে।
আলেমরা জানান, ‘আল-হাইআতুল উলয়া লি-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-তে ছয়টি বোর্ড সক্রিয়। এরমধ্যে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বা বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড সবচেয়ে বড়। বাকিগুলো আঞ্চলিক প্রধান বোর্ড।
জানতে চাইলে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কোনও কিছুই জানানো হয়নি। ফলে এ বিষয়ে বলার মতো কিছু নেই। যদি কখনও প্রস্তাব আসে, তখন আমাদের ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে। এই মুহূর্তে আর বলার কিছু নেই।
এ বিষয়ে সরকারি স্বীকৃত কওমি মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ ‘আল-হাইআতুল উলয়া লি-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর সদস্য মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমাদের মাদ্রাসাগুলো আগে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এখন চিত্র পাল্টেছে। ইতোমধ্যে আইনের মাধ্যমে বোর্ড হয়েছে। একটি বোর্ডের অধীনে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। হঠাৎ করে আবার নিয়ন্ত্রণের আলোচনা কেন?’
বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহ-সভাপতি মুসলেহ উদ্দিন রাজু আরও বলেন, ‘আমাদের কিছু জানানো হয়নি। কোনও চিঠিও পাইনি। এমনও হতে পারে, সরকারের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার সম্পর্ক আবার বাজিয়ে দেখার জন্য এমন কথাবার্তা সামনে আনা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী যে কথা বলেছেন, তিনি হয়তো পুরোপুরি না জানার কারণে বলেছেন। আমরা নিজেরাও এ বিষয়ে কোনও আলোচনা করিনি।’
তিনি জানান, শিক্ষা আইন ২০২১-এর পঞ্চম অধ্যায়ে কওমি শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে। সেখানে সরকারের সহযোগিতার বাইরে তেমন কিছু নেই।
কওমি মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ আলেমরা বলছেন, ২০১৭ সালে সরকার যে আইনের ভিত্তিতে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে, নতুন করে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ তার বিপরীতে যায়।
জানতে চাইলে সোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ও আল হাইআতুল উলয়া’র সদস্য আল্লামা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘সরকার তো মাদ্রাসার সঙ্গে চুক্তি করেছে দেওবন্দের ছয় নীতির ভিত্তিকে সামনে রেখে। এখন যদি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়, তাহলে সেটা আইনের ও চুক্তির বরখেলাপ হবে। বিষয়টি সামনের আনার কী কারণ থাকতে পারে জানি না।’
মাওলানা মাসঊদ আরও বলেন, ‘সরকার এমন কোনও উদ্যোগ নিতে একবার আল হাইয়াকে আমন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু হাইয়ার পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, কী ভিত্তিতে চুক্তি হয়েছে। একইসঙ্গে যে আইনের ভিত্তিতে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই আইনেই সরকার আবার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আনতে পারে না। পরে সরকারের পক্ষ থেকেও কোনও কিছু বলা হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত বছরের রমজানে কওমি মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সংক্রান্ত বিষয়ে একটি বৈঠকে অংশ নিতে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। যদিও আল হাইআ ওই বৈঠকে যোগ দেয়নি।