এইচ.এম. মশিউর রহমান: চারপাশে মানুষের জীবন যখন সার্বিক ভাবে বিপর্যস্ত। মানুষ যখন দুমুঠো আহারের জন্য হাড়-ভাঙা খাটুনির পরেও একপ্রকার হিমশিম খাচ্ছে। জীবনের কোন দিকদিগন্ত পাচ্ছে না। মানুষের ভাতের নিশ্চয়তা হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত ঠিক সেই মুহূর্তে সরকার মূল্য সংযোজন কর বৃদ্ধি করে মানুষের জীবন যাত্রাকে আরো বিপাকে ফেলে দিয়েছে। মানুষের এখন “মরার উপর খরার ঘা” অবস্থা। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে চারপাশের দরিদ্র মানুষের জীবন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে সাধারণ মানুষ শঙ্কা প্রকাশ করছে। মানুষের আশ্রয় বলতে আর কোন জায়গা থাকলো কই। মানুষের জন্য ভাবার আর মানুষ থাকলো কই। অন্তর্বতীকালীন সরকারের হঠাৎ করেই মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মানুষের দিশেহারা অবস্থা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপেই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধন আনতে যাচ্ছে সরকার। এতে তৈরি পোশাক, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, বিস্কুট, আচার, কয়েল ও টিস্যু পেপার, নন-এসি হোটেলসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে। ভ্যাট বাড়লে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে বাজেটের আগেই এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে পারে। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য। ইতোমধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে শুরু করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হতো।
এরই মধ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে আরেক দফা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র অবস্থা তৈরি হয়েছে। পোশাক, মিষ্টি, টিস্যু, এলপি গ্যাস, সস, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম ও গ্লাস, মোবাইল ফোনের কল রেট, ফল ও বিদেশ ভ্রমণের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক কর বৃদ্ধি ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। এতে মানুষের জীবন নির্বাহে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রভাব পড়ছে উৎপাদনেও। এর ফলে নিত্যদিনের খরচ আরও বেড়ে যাবে, দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।
সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সের জেরে জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষও এই ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপের কারণে কাহিল হয়ে পড়েছে। কারণ, মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ ব্যয় যখন বেড়েই চলছে, তখন সরকারের এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী বলে এরই মধ্যে বলা শুরু হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। সামনে পবিত্র রমজান মাস। ফলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এবারের রমজান মাসে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ও খরচ আরও বাড়বে। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেছেন, ‘যেসব পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে, তার কোনও প্রভাব পড়ছে না ক্রেতা পর্যায়ে। এর মধ্যে নতুন করে শুল্ক-কর বাড়ানোর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে। এই ব্যয় অন্তত ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে।’
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সরকারের ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর তালিকায় এমন অনেক পণ্যসেবা আছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’ তার মতে, বিরূপ প্রভাব শুধু গরিবের ওপরই পড়বে না, মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপরও চাপ পড়বে। এটা সাধারণ মানুষকে চাপের মধ্যে ফেলবে । তিনি বলেন, ‘সামর্থ্যবান অনেকেই সঠিকভাবে কর দেন না। সেখানে হাত দেওয়া উচিত ছিল।’
অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক আরোপিত কর ও ভ্যাট জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়াবে বলে মন্তব্য করেছে বিএনপিও। শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ সরকারের সিদ্ধান্ত ‘অপরিণামদর্শী’ অভিহিত করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে দলটি। রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপে সাধারণ মানুষের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেছেন।
তাহলে সকলেই যখন বুঝতে পারছে এবং অনুধাবন করছে যে এই মুহূর্তে ভ্যাট বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তাহলে উর্ধতনরা কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণকে বিপাকে ফেলে দিলো।
এই মূহুর্তে সরকারের অবশ্যই উচিৎ যে কোন বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বসাধারণ শ্রেণীর কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে নেওয়া । আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের মানুষ তারা কোন রকম দিন আনে দিন খেয়ে বেঁচে থাকে। এই মানুষ গুলোর জীবন অবস্থা সংকটে পড়েছে তাদের কথা চিন্তা করে যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের কাঁধে ভর করেই দেশ পরিচালিত হয়। আর সে জন্য যে কোন সিদ্ধান্তের আগে এই সকল মানুষের কথা চিন্তা করা সবচেয়ে জরুরি। তাদের কথা চিন্তা করেই যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাষ্ট্রের যে কোন সিদ্ধান্ত যেন জনগণ বান্ধব হয় এটা মাথায় রাখতে হবে সবার আগে।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।