The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
বুধবার, ৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এর নেতৃত্বে দুদকের অগ্রযাত্রা

সম্পাদকীয়: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তার কর্মকর্তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। অন্তবর্তীকালিন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহনর পরেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল, জনবান্ধব ও সংস্কারে গঠিত হয় একাধিক কমিশন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ২৯ অক্টোবর পূর্বের কমিশনের সবাই ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। এরই ধারাবাহীকতায় দুর্নীতি দমন কমিশন,  দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। স্থিমিত হয়ে পড়া দুদককে আবারও তিনি নিয়ে আসেন স্বাভাবিক কার্যক্রমের ধারায়। নতুন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বর্তমানে হার্ডলাইনে আছে দুদক। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও মামলা প্রক্রিয়া।

দুদক সুত্রে জানা যায়, নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহেন পর থেকে এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক দুর্নীতিবাজ দুদকের জালে আটকা পড়েছেন। যে প্রক্রিয়া চলমান আছে। প্রতিনিয়তই বাড়ছে দুদকের কার্যপরিধি, অনুসন্ধান-মামলা ও তদন্ত কার্যক্রম। নতুন কমিশনের নেতৃত্বে এই অগ্রযাত্রা চলমান থাকবে এমটিই আশা।

সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায়, এ ধরনের অভিযান বা কার্যক্রমে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন বা হতে পারেন, তাঁদের এর প্রশংসা করার কথা নয়। তাঁরা সমালোচনা এবং সময় ও সুযোগ বুঝে এর বিরুদ্ধে অবস্থানও নিতে পারেন। তবে দেশের বিবেকবান মানুষের সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক নেই। বরং দুর্নীতি তাঁদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে পড়েছে। তাই তাঁরা দুদকের এ কার্যক্রমের প্রশংসা করবেন ও সমর্থন জানাবেন, এটাই স্বাভাবিক। চাইবেন এ ধরনের অভিযান জোরদার হোক। আঘাত করতে সক্ষম হোক দুর্নীতির ঘাঁটিতে।

২০০০ সাল থেকে পরপর কয়েকবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের কুখ্যাতি আমরা অর্জন করেছিলাম। এরই পটভূমিকায় সুশীল সমাজ একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন দাবি জানাতে থাকে। উন্নয়ন–সহযোগী রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোও এ বিষয়ে অনুকূল অবস্থান নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালে একটি আইনের মাধ্যমে গঠিত হয় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু এর নেতৃত্বে যাঁদের নেওয়া হয়, তাঁরা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পেরেছেন খুব কমই। ক্ষেত্রে বিশেষ তারা দলিয় সরকারের হয়েও কাজ করেছেন। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে ড. মোমেন কমিশনের হাতে এক বিরাট সুযোগ এসেছে কাঠামোবদ্ধ দুর্নীতির মূলে আঘাত হানার। সে অনুযায়ী তিনি ও তার কমিশন কর্মতৎপরতাও চালাচ্ছেন। তাই তো ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বে দুদকের বর্তমান অগ্রগতি আশা জাগিয়েছে সর্বসাধারনের মাঝে।

দেশি-বিদেশি সব অর্থনীতিবিদই মনে করেন, আমাদের দেশে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রিত হলে জিডিপি প্রায় ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। সম্প্রতি দুদক চেয়াম্যানের উপস্থিতে দুর্নীতি প্রতিরোধে কুমিল্লায় গণশুনানির আয়োজন করে দুদক। যেখানে তিনি দৃড়ভাবে বলেন দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। এই সাথে তিনি ৫ আগস্টের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেদিন যে আন্দোলন হল বা এখনও হচ্ছে তার মূলেই ছিল এ দুর্নীতি। সমাজের অবিচার, অনিয়ম, দুর্নীতির মূল উৎপাটনে তার সহকর্মীদের নিরলস কাজ করার আহ্বানও জানান তিনি।

দুর্নীতিবাজ যতই প্রভাবশালী হোক ছাড় দিচ্ছে না আবদুল মোমেন কমিশন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সরকার প্রধান থেকে শুরু করে তার পরিবারের সদস্য ও বড় বড় রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান ও মামলা রূজুর বিষয়টি এগিয়ে নিচ্ছেন। আমরা সকলেই জানি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।

অন্তবর্তীকালিন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ, সিআইডি ও দুদকের সহায়তায় বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে কাজ শুরুও করে। উক্ত কাজে দুদকের সার্বিক সহায়তায় যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয় সেখানে দেখা যায় গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন বা এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। টাকার অংকে যা প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। পাচার হয়ে যাওয়া এই টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে দুদকের বর্তমান কমিশনও কাজ করে চলেছে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি বলেছিলে, “আমাদের গরীব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা যেভাবে তারা লুণ্ঠন করেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। দুঃখের বিষয় হলো, তারা প্রকাশ্যে এই লুটপাট চালিয়েছে। আমাদের বেশিরভাগ অংশই এর মোকাবিলা করার সাহস করতে পারেনি”। আর সেই দূরহ কাজের আঞ্জাম দিয়ে চলেছেন বর্তমান কমিশন।

শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান ও মামলা: ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা করে ৬ প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের ৬ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্লট নেওয়া ৬ জন হলেন-সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ (জয়), মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল), ছোট বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রেদোয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি এবং রেহানার মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকী।

অনুসন্ধান পরবর্তী হাসিনা পরিবারের জালিয়াতির বিষয়টি সামনে চলে আসলে নানা রকম চাপ উপেক্ষা করে বর্তমান কমিশন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তাদের পরিবারের সদস্য সহ জড়িত ১৬ জনের নাম উল্লেখপূর্বক একটি মামলার সুপারিশ করেন। যা সম্ভব হয়েছে বর্তমান কমিশনের সদিচ্ছার মাধ্যমে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় আবাসন সুবিধা থাকার পরও ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নিজের ও ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়ের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের কূটনৈতিক জোনের ২০৩ নম্বর রোড থেকে ১০ কাঠা করে মোট ২০ কাঠার দুটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন।

তাদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১৬১/১৬৩/১৬৪/৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে দুদক জানায়।

তাছাড়া রেহানা, ববি ও রূপন্তীসহ ৪৭ জনকে আসামি করে ৩টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় শেখ হাসিনা ও টিউলিপকে সহযোগী আসামি করা হয়েছে। যা এই কমিশনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অন্যতম অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।

ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান: ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশে চলাচলের জন্য ওবায়দুল কাদের ও সাবেক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী পছন্দের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ১৩৭টি বাস কিনতে চেয়েছিলেন; কিন্তু সেটা করতে না পেরে পুরো প্রক্রিয়াকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এই অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া ক্ষমাতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে শত কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগও আছে যা বর্তমান কমিশনে নির্দেশনায় অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা যায়।

আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই নেতার বিরুদ্ধে মামলা: আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই সদস্য সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান ও দলটির প্রেসিডিয়াম মেম্বার কাজী জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের ঘটনায় মামলা হয়েছে শাহজহান খানের স্ত্রী ও ছেলের বিরুদ্ধেও। এছাড়া এফডিআর একাউন্ট খুলে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জফরুল্লাহ সহ ছয় জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

তাকসিম খানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা: ওয়াসার তাসকিম সাবেক প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের লোক ছিলেন। তথাপি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জনবল কাঠামোবহির্ভূত নিয়োগ দিয়ে দুর্নীতি করার অভিযোগে ঢাকা ওয়াসার পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানসহ বোর্ডের ১০ জনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সাবেক আইন মন্ত্রী আনিসুল হকের বিরুদ্ধে মামলা: ১৪৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া দুদক আনিসুল হক সংশ্লিষ্ট ২৯টি ব্যাংক হিসাবে ৬৬৫,৬৪,০৩,১৯০/- টাকার সন্ধেহজনক লেনদেনের বিষয়েও তথ্য পায়।

সাবেক খাদ্য মন্ত্রী কামরুল ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা: সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের’ অভিযোগে মামলা করেছে দুদক।
ঢাকা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় ৬ কোটি ২৯ লাখ টাকার ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের’ অভিযোগ আনা হয়েছে।
নিক্সন চৌধুরী ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা : শেখ হাসিনা আত্মীয় ফরিদপুরের সাবেক সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন এবং তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে তিন হাজার ১৬২ কোটি টাকা অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পায় দুদক। তাকেও ছাড় দেওয়া হয়নি, হয়েছে মামলা।

এস আলমের ছেলেসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা: বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অন্যতম একটি কালো অধ্যায়ের রচয়িতা এই এস আলম গ্রুপ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ মদতে দেশের ব্যাংগুলোকে তারা চর দখলের মতো করে একে একে দখলে নিতে শুরু করে। আর্থিক খাতে সৃষ্ট অরাজকতার পেছনে এই পরিবারের হাত আছে সেটা বলাই বাহুল্য। সেই কালো অধ্যায়ের ইতি টানতে দুদকও পদক্ষেপ নিয়েছে, যা স্বস্তিদায়ক। সম্প্রতি ক্ষমতার অপব্যবহার করে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মুনাফাসহ ৯১৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আহসানুল আলম বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের (এস আলম) ছেলে।

সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের দুর্নীতি অনুসন্ধান: রাষ্ট্রিয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের শত কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগের সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে বর্তমান কমিশন।

সাবেক সাংসদ, বরগুনার বিরুদ্ধে মামলা: ধীরেন্দ্র দোবনাথ শম্ভু, সাবেক সংসদ সদস্য, বরগুনা-১ সরকারের দায়িত্বশীল পদে থেকে অবৈধ উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ ৫,৪১,২০,১২৫/- (পাঁচ কোটি একচল্লিশ লক্ষ বিশ হাজার একশত পঁচিশ) টাকা মূ্ল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করে ভোগ দখলে রাখা এবং নিজ নামে ১৬টি ব্যাংক হিসাবে মোট ৪১,৯৩,২৫,৭০২/- টাকার অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেন করে উক্ত টাকা হস্তান্তর, রুপান্তর ও স্থানান্তর করার অপরারে বর্তমান কমিশন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় একটি মামলা রুজু করে।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সহ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা: জ্বালানি খাতের অন্যতম দুর্নীতিবাজ সাবেক মন্ত্রী নসরুল হামিদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান ও মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করছে বর্তমান কমিশন। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর আয়ের হিসাব পর্যালোচনা করে আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ৩৬,৩৬,৯৯,৬৫৭/- (ছত্রিশ কোটি ছত্রিশ লক্ষ নিরানব্বই হাজার ছয়শত সাতান্ন) টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জন ও ভোগ দখলে রাখা সহ নিজ নামে ৯৮টি ব্যাংক হিসেবে মোট ৩১৮১,৫৮,৮৩,৩১৩/- (একত্রিশ শত আশি কোটি তেইশ লক্ষ আটাত্তর হাজার সাতশত উনত্রিশ) টাকার অস্বাভাবিক ও সন্দেহজন লেনদেনের তথ্য পায় অনুসন্ধান টিম। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় একটি মামলা রুজু করে। এছাড়াও নসরুল হামিদের সন্তান জারিফ হামিদ, স্ত্রী- সীমা হামিদের বিষয়েও পদক্ষেপ নিয়েছে বর্তমান কমিশন।

কুমিল্লার ত্রাস আ.ক.ম বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা: আ.ক.ম বাহাউদ্দিন সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক দুর্নীতির মাধ্যমে অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ৬৭,,৪৩,১৩,৮৩৬/- (সাতষট্টি কোটি তেতাল্লিশ লক্ষ তের হাজার আটশত ছত্রিশ) টাকা মূল্যের অবৈদ সম্পদ অর্জণ একই সাথে ২৯টি ব্যাংক হিসাবে ২৫৮,৬৮,৬৩,৯০৫/- (দুইশত আটান্ন কোটি আটষট্টি লক্ষ তেষট্টি হাজার নয়শত পাঁচ) টাকার অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেনের অপরাধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় অপরাধ করায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনে বর্তমান কমিশন একটি মামলা রুজুর অনুমতি প্রদান করেন।

সাবেক সাসংদ, নরসিংদী-২ বিরুদ্ধে মামলা: আনোয়ারুল আশরাফ খান, সাবেক সংসদ সদস্য, নরসিংদী-২ কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহার পূর্বক অবৈধ উপায়ে ১১,৮২,৯০,৩১৭/- টাকার জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জন করে ভোগ দখলে রাখার এবং অবৈধভাবে ৪৪১,১৬,৬৪,২০৫/- কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়ায়া তার বিরুদ্ধে একটি এজহারের অনুমোদ দেন বর্তমানা কমিশন।

সাবেক এমপি গোলন্দাজ-জিল্লুল হাকিম পরিবারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা: কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল ও রাজবাড়ী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. জিল্লুল হাকিমের পরিবারের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

গোলন্দাজের বিরুদ্ধে ২০ কোটি ১১ লাখ ২০ হাজার ৪৬০ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ১৬ টি ব্যাংক হিসাবে ৬০ কোটি ৯৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা ও ১ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৬ মার্কিন ডলারে অস্বাভাবিক লেনদেন করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

দ্বিতীয় মামলায় জিল্লুল হাকিমের সঙ্গে আসামি হয়েছেন স্ত্রী সাঈদা হাকিম। সাঈদা হাকিমের বিরুদ্ধে ৪ কোটি ২৭ লাখ ৭২ হাজার ১০৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ৬ টি ব্যাংক হিসাবে ২০ কোটি ২৪ লাখ ৩১ হাজার টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

আলোচিত সংসদ সদস্য হেনরির বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার: দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরীকে গ্রেফতার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করে। এরই প্রেক্ষিতে মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেন গালিব দুদকের আবেদন মঞ্জুর করে হেনরীকে গ্রেফতারের আদেশ দেন। হেনরীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপরাধমূলক অসদাচারণের মাধ্যমে ৫৭ কোটি ১৩ লাখ ৭ হাজার ২২৩ টাকা জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ৩৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২ হাজার ২ কোটি ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৭ টাকার এবং ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ মার্কিন ডলারের সন্দেহজনক লেনদেন করে মানিলন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধের অভিযোগ আনে কমিশন।

সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব কবির আনোয়ারের বিরুদ্ধে মামলা: সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রবল ক্ষমতাশালী আমলা কবির বিন আনোয়ারের দুর্নীতি, জালিয়াতি, অনিয়মের প্রমান পেয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে বর্তমান কমিশন। দুদকের অনুসন্ধানে তাঁর (কবির) নামে প্রায় তিন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়া যায়। তাছাড়া তাঁর স্ত্রী তৌফিকা আহমেদের বিরুদ্ধে চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া উভয়ের ১৫টি ব্যাংক হিসাবে ২৩ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য প্রাপ্তির ভিত্তিতে এই মামলা রুজু করে বর্তমান কমিশন।

এসকে সুরের বাসায় দুদকের অভিযান: দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এসকে) সুর চৌধুরীর বাসায় অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ধানমন্ডিতে তার বাসায় অভিযান চালিয়ে নগদ ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা উদ্ধার করে দুদক টিম। উল্লেখ্য গত ১৪ জানুয়ারি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তায় দুদকের একটি টিম তাকে গ্রেপ্তার করে।

২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। অভিযোগ রয়েছে, রিজার্ভ কেলেঙ্কারি চাপা দিতে এসকে সুর চৌধুরীর বড় ভূমিকা ছিল। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে, যা খতিয়ে দেখতে তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংকে তার ভোল্টে ইতোমধ্যে বিপুল পরিমান অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণের সন্ধান পেয়েছে দুদক। বর্তমান কমিশন এসকে সুর চৌধুরীর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন বলে জানা যায়।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা: জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মহিবুল হাসান চৌধুরীর ঘোষিত সম্পদ বিবরণীতে ৫ কোটি ৪৪ লাখ ১৯ হাজার ৮১০ টাকার স্থাবর সম্পদ ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন। যার মধ্যে ২ কোটি ৯৪ লাখ ৪২ হাজার ৬১৮ টাকার সম্পদের হিসাব পাওয়া যায়নি। তাই তার বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

মহিবুল হাসান চৌধুরী ওরফে নওফেলের নিজ এবং তার প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে পরিচালিত ৪১ টি হিসাবে মোট ১১৩ কোটি ৮৯ লাখ ৪৩ হাজার ৬২৮ টাকা জমা ও ৯৭ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার ৬১৭ টাকা উত্তোলন করেছেন মর্মে দুদক প্রমান পায়।

এছাড়া বর্তমান কমিশন নিজাম উদ্দিন হাজারী, সাবেক সংসদ সদস্য, ফেনী-২, মো: জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী, সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাইফুজ্জামান (শেখর), সাবেক সংসদ সদস্য, মাগুরা-১, নারায়নগঞ্জের শামীম ওসমান, শেখ ফজলে নুর তাপস, সাবেক মেয়র, ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশন, তাজুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী, স্থানীয় সরকার, মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানের মত হেভিওয়েট ও ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান ও মামলা রুজুর বিষয়ে অগ্রনি ভুমিকা পালন করে চলেছে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নের্তৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন।

সাধারন মানুষের আশা এই প্রক্রিয়া যাতে চলমান থাকে এবং বিগত ১৭ বছর দেশে যে কাঠামোবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে তা যাতে স্বমূলে উপড়ে ফেলা যায়। বর্তমান কমিশনে সার্বিক ইতিবাচক কর্মকান্ড জনবান্ধব হওয়ায় সাধারণ মানুষও দুদককে আপন করে নিতে শুরু করেছে।

অনেকেই বলে থাকেন, আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন তেমন কার্যকর নয়। কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তবে সত্য কথা হলো, যথাযথ জনসম্পৃক্তা, জনসচেতনতা ছাড় দুদকের পক্ষে সারা দেশের সর্ব স্থরের দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তাছাড়া সারা দেশের দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণও দুদকের কাছে নেই। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির অনুসন্ধানের জন্য ১৯৫৩ সালে ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ সৃষ্টি হলেও পরবর্তী সময়ে কমিশনের জন্য প্রণীত আইনে দুদকের অধিক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় জনবল ও অফিস বিস্তৃতি হয়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকলেই কেবল দুদক কাজ করতে পারে। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থকে বিভিন্নি অনুবিভাগগুলো পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় আরো কর্মতৎপর হয়েছে। দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযোগ পেলেই হানা দিচ্ছে দুর্নীতির আখড়ায়। অনুসন্ধান বিভাগকে সর্বচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন চেয়ারম্যান।

গত ৫০ বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো, আমরা দুর্নীতি রোধ করতে পারিনি। দুর্নীতির পরিসর বেড়েছে। আগামীতে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো কার্যকর করে তুলতে যোগ্যদের যথাস্থানে পদায়নের বিকল্প নেই। যেকোনো মূল্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রতিহত করতে হবে। আর সেই লক্ষেই বর্তমান কমিশন শত বাধা উপেক্ষা করেও শেখ হাসিনা পরিবারসহ রাজনৈতিক দুবৃত্তদের দুর্নীতি অনুসন্ধান ও মামলা রূজুর সাহস দেখিয়েছেন। জানা যায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ যাতে অনুসন্ধান করা না হয় তার জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকার তহবিল রেডি করা হয়েছে। সরকারের ভেতর থেকেও হতে পারে অস্থিরতা, তদন্ত কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টাও করা হতে পারে। শত চাপ উপেক্ষা করেও দুবৃত্তদের বিরুদ্ধে সার্বিক কার্যক্রম চালু রাখার জন্য বিদ্যমান কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনকে আমাদের সাধুবাদ জানাতেই হবে।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.