মঈনুল হাসান মাসুম, বুটেক্স প্রতিনিধি: ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ১৪তম জন্মদিন তথা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। যাত্রার শুরু থেকে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি উচ্চশিক্ষায় একটি দৃঢ় ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে এসেছে।
এটি বাংলাদেশের একমাত্র বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শুধুমাত্র টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিষয়গুলো পড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে উদ্যোক্তা ও শিল্পায়নকে টিকিয়ে রাখাসহ টেক্সটাইল প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে।
আজকের এই বুটেক্সের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯২১ সালে। ঢাকার নারিন্দাতে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলের সময় টেক্সটাইলের উপর কারিগরি শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘দি ব্রিটিশ স্কুল অব উইভিং’। কালের পরিক্রমায় দেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক শিল্পের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে এটিকে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করে এবং ২০১১ সালের ১৫ মার্চ এটিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চালু করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবসকে ঘিরে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তাদের অনুভূতি ও প্রত্যাশার কথা।
অ্যাপারেল ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নিয়াজ মোর্শেদ শুভ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমাদের সবারই বেশ কিছু প্রত্যাশা থাকে। যেগুলো আমরা সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আশা করি, এর মধ্যে অন্যতম হলো একটি বিশাল ক্যাম্পাস। এটি হইতো এই মুহূর্তে সম্ভব না কিন্তু আমার মনে হয় আশেপাশের অনেক জমি ফাঁকা পরে আছে যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণ শুরু করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, ইন্ডাস্ট্রিতে একজন বস্ত্র প্রকৌশলী হিসেবে আমাদের প্রাথমিক বেতন ভাতা বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অনেক কম থাকে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ তৈরিতে শিক্ষকদের এ বিষয়ে ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সাথে আলোচনায় বসা উচিত। আমাদের দীর্ঘদিনের আক্ষেপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শক্তিশালী অ্যালামনাই গড়ে তোলা এবং বিভিন্ন জটিলতায় আটকে থাকা সমাবর্তনটি অতি দ্রুত আয়োজন করা।
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাদিকুল ইসলাম সাঈদ বলেন, ৫ই আগস্টের আগের এবং পরের বাংলাদেশে বিশাল একটি পরিবর্তন হলেও বুটেক্সে এমন কোন পরিবর্তন আমরা এখনো দেখতে পাইনি। আমাদের বিভিন্ন পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন কমিটি দেওয়া হয়। কিন্তু স্পেশাল সাপ্লি পরীক্ষা চালু করা ছাড়া এসব কমিটির কোন সাফল্য চোখে পড়েনি।
তিনি আরও বলেন, পর্যাপ্ত আবাসিক হল না থাকায় ঢাকার বাইরে থেকে আসা অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। আবার যেসব হল রয়েছে, সেসব হলে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব। এছাড়াও আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রশাসনের কাছে অর্থ বরাদ্দ চাইলে তা দিতে অনেক কৃপণতা দেখা যায়। প্রশাসনের সব বিষয়ে এত উদাসীনতা কেন?
বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে প্রত্যাশা, এসব সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন খুব শীঘ্রই পদক্ষেপ নিবেন এবং অপূর্ণতা গুলো কাটিয়ে এগিয়ে যাবে বুটেক্স। আমাদের কাঙ্খিত সোনার বাংলা বিনির্মাণে আগামী দিনেও ভূমিকা রাখতে পারবে আমাদের প্রিয় বুটেক্স।
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সৈয়দ মাহমুদ হাসান মাহি বলেন, ১৯২১ থেকে ২০২৪, নারিন্দায় প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ উইভিং স্কুল থেকে আজকের বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়। সুদীর্ঘ এই পথচলা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড বস্ত্র প্রকৌশল খাতকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী সরবরাহ করার এক বর্ণাঢ্য যাত্রা। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্রেডমার্ককে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার পেছনে রয়েছে হাজারো বুটেক্সিয়ানদের মেধা আর অক্লান্ত পরিশ্রম। দেশের বস্ত্র প্রকৌশল খাতের একমাত্র বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪তম বর্ষপূর্তিতে সবাইকে আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
তিনি আরও বলেন, সম্পূর্ণ শিল্প ভিত্তিক এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আরো বেশি মাত্রায় যুগোপযোগী ও কার্যকর করে তুলতে গবেষণায় গুরুত্বারোপের কোনো বিকল্প নেই। ইন্ডাস্ট্রি এবং একাডেমিক সহযোগিতার মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা সমাধানে নতুন আবাসিক হল নির্মাণ করা অত্যন্ত জরুরি। আমি মনে করি যৌক্তিক এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে বুটেক্স নিজেকে ছাড়িয়ে পৌঁছে যাবে বিশ্বসেরার মঞ্চে। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে এই আমার প্রত্যাশা।
ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রেযোয়ান আহমেদ লস্কর বলেন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) দেশের বস্ত্র শিল্পের প্রাণকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটি দক্ষ বস্ত্র প্রকৌশলী তৈরিতে অসামান্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। ১২ একরের ছোট্ট এই ক্যাম্পাসের শত শত শিক্ষার্থী তাদের মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে দেশের টেক্সটাইল খাতে অনন্য অবদান রেখে চলেছে।
বুটেক্সের বিভিন্ন সাফল্যের পাশাপাশি কিছু সংকটও বিদ্যমান। এসব সংকটের মধ্যে অন্যতম পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগের অভাব। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলেও তেমন কোনো রিসার্চ ক্লাব নেই। এছাড়াও লাইব্রেরীতে প্রয়োজনীয় বইয়ের ঘাটতি পূরণ, ডাইনিং এবং ক্যান্টিনে মানসম্পন্ন খাবার সরবরাহ এবং আবাসিক হলে নিরাপত্তার বিষয়গুলোতে প্রশাসনের নজরদারি আবশ্যক।
এছাড়াও এত বছরের পথচলায় এখনও কোনো সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়নি, যা হতাশার। “জ্ঞানই শক্তি” এই নীতিতে বিশ্বাসী বুটেক্স দ্রুতই এসব সমস্যার সমাধান করে আগামী দিনেও দেশের টেক্সটাইল খাতে অনন্য অবদান রেখে যাবে ইনশাআল্লাহ।
ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো: ফারহানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে টেক্সটাইল শিল্পের প্রাণকেন্দ্র বুটেক্স। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠ, ২০১০ সালে দেশের একমাত্র টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা লাভ করে। ১২একরের ছোট্ট ক্যাম্পাস, কয়েক হাজার তরুণ-তরুণী, প্রতিদিন নতুন কিছু না কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা যা রীতিমতো অবাক করার মতো। ক্যাম্পাসটি একদম ন্যানো-চিপের মতো করে সাজানো।
তিনি আরও বলেন, বুটেক্সে ভর্তির দিন থেকেই এই ক্যাম্পাসের সিনিয়রদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। অত্যাধুনিক ল্যাব, শিল্প-ভিত্তিক নতুন পাঠ্যক্রম এবং গবেষণার সুযোগ এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য করে তুলেছে। ল্যাবে ব্যবহারিক সরঞ্জামাদির পরিমাণ বাড়ানো, প্রশাসনিক কাজে ভোগান্তির অবসান, ওয়েবসাইট সহ বিভিন্ন অনলাইন কার্যক্রমে আরো বেশি আধুনিক হওয়া এবং হলগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক সমালোচনা ও সার্বিক দিক বিবেচনায় এনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই প্রতিষ্ঠানটিকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। বুটেক্স কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি হয়ে উঠবে বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের অন্যতম শক্তিশালী ভীত।
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী প্রত্যয় গাঙ্গুলি বলেন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় একটি ভিন্নধর্মী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় যা মূলত বস্ত্রপ্রকৌশল নিয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রদান করে থাকে। এটি বাংলাদেশ এবং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বস্ত্রপ্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। বুটেক্সকে তার ১৪ তম জন্মদিনে জানাই অনেক অনেক শুভকামনা।
আমাদের ক্যাম্পাসটি অনেক ছোট হওয়ায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে রয়েছে এক বন্ধুত্বসুলভ মনোভাব যা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বিরল। প্রতিষ্ঠার ১৪ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্জন অনেক। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবগুলোর রয়েছে নজরকাড়া অর্জন। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি সাংস্কৃতিকভাবেও অনেক বেশি সমৃদ্ধ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।
তবে প্রতিষ্ঠার এত বছর পড়েও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে নানা অনিয়ম ও সংকট। পর্যাপ্ত গবেষণার অভাব, শ্রেণিকক্ষ আধুনিকরণের অভাব,ক্যান্টিনের দুরবস্থাসহ আরও নানা বিষয়। আমরা আশাকরি বুটেক্স তার সকল সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে এগিয়ে যাবে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।
উল্লেখ্য, আগামী ২২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বুটেক্স প্রশাসন। সকাল ৯:৩০ ঘটিকায় পায়রা অবমুক্তকরণ, বেলুন উড়ানো এবং কেক কাটার মাধমে অনুষ্ঠানের সূচনা হবে এবং সমাপ্তি হবে দুপুর ৩ টায় সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধমে। বুটেক্স পরিবারের সকলকে উক্ত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।