মো. সবুজ হোসেন: বর্তমানে আমরা বসবাস করছি আধুনিক বিশ্বে। এই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিশ্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তথ্যের অবাধ প্রবাহ। ফলে আমরা যেকোনো তথ্য খুব সহজেই পেয়ে থাকি। একটা সময় ছিল যখন বই ই ছিল তথ্য প্রাপ্তি একমাত্র উৎস।
এখনও আমাদের জন্য বই পড়া সমান প্রাসঙ্গিক- কারণ বই শুধুমাত্র কালো অক্ষর মুদ্রিত কতগুলো পৃষ্ঠার সমষ্টি নয়। বইকে তুলনা করা যেতে পারে একটি বহমান নদীর সাথে,নদী যেমন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নিয়ে চলে অবারিত জলের ধারা।বইও বয়ে নিয়ে চলে শতাব্দী প্রাচীন জ্ঞান এক শতাব্দী থেকে অন্য শতাব্দীতে।
বই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন “বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়া বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে! কে জানিত সঙ্গীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দ-ধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে! কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্ত্তমানে বন্দী করিবে! অতলস্পর্শ কাল-সমুদ্রের উপর কেবল একএকখানি বই দিয়া সঁকো বাঁধিয়া দিবে!”
সভ্যতার কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লক্ষণ জাতিগত সৌকর্য এবং নান্দনিকতার চিহ্ন হিসেবে কাজ করে, তাদের মধ্যে বই একটা সৃষ্টিশীল নিদর্শন। আমরা যাদের সভ্য জাতি বলি তাদের বৈশিষ্ট্যের অনেক গুলো মানদন্ডের মধ্যে নিশ্চিত ভাবে বই একটা। তাই সমাজের উন্নতি জন্য বই একটা আলাদা গুরুত্ব বহন করে। আলো যেমন জাগতিক নিয়মে অন্ধকার দূর করে সব কিছু মূর্ত করে , তেমনি বই মানুষের মনের ভেতরে জ্ঞানের আলো এনে যাবতীয় অন্ধকারকে দূর করে চেতনার আলোকে সবকিছুকে উদ্ভাসিত করে দেখায়।
ম্যালকম এক্স বলেছেন “ভালো বই পড়ার মাধ্যমে আমি মুক্ত হয়েছি, এবং যদি আমি পড়ার সুযোগ না পেতাম, তাহলে আমি সতর্কতা অবলম্বন করছি আজও অন্ধকারে থাকো।”
আলো শুধু ভৌগোলিক ভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে। আর বই অতীত থেকে ভবিষ্যৎ , নিকট থেকে দূরে , প্রান্ত থেকে অন্তে এমনকি যুগ থেকে যুগান্তরে জ্ঞানের আলোকে পৌঁছে দিতে পারে । তাই দেশ কালের সীমানা অতিক্রম করে জ্ঞানের আলোকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে একমাত্র বই । শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হল আত্মশিখন । আর বই সেই আত্মশিখনের শ্রেষ্ঠ সহায়ক । বিনোদন থেকে শিক্ষা , অবসর যাপন থেকে নিঃসঙ্গতা দূর — সবেতেই বই শ্রেষ্ঠ অবলম্বন হতে পারে । বই মানুষের জীবনে অনেক ক্ষেত্রে বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, শিক্ষক এমনকি অভিভাবকদের চেয়ে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
মানুষের ভিতরের অন্ধকার দূর করে কুসংস্কারমুক্ত, প্রগতিশীল,আলোকিত সমাজ, দেশ ও জাতি গঠনে বই হলো শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। পৃথিবীর ইতিহাস ঐতিহ্য ও আধুনিক বিশ্বকে উপলব্ধি করতে হলে বই পড়তে হবে । বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, জাতি , ভাষা গুষ্টির মানুষ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায় । বই মানুষের হৃদয়ের দ্বার খুলে দিয়ে চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করে এবং মানুষের আত্মার প্রসার ঘটায়। মানুষ আসলে শ্রেষ্ঠ না, তাকে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতে হয়। আর শ্রেষ্ঠ কিংবা ব্যতিক্রম হতে হলে অবশ্যই তাকে বইয়ের কাছে আসতে হবে, পড়তে হবে নির্বাচিত বই৷ আর একবার বই পড়া শুরু করলেই ধীরে ধীরে আত্মপরিচয়ের অন্বেষণে যেতে পারে মানুষ। তাতেই এগিয়ে যায় সময় ও সমাজ।বই পড়ার মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
যখন একজন ব্যক্তি নিয়মিত বই পড়ে,তখন তার শব্দ ভান্ডার বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বই চাপ কমানোর জন্য একটি ভালো অভ্যাস হতে পারে। নিয়মিত বই পড়ার ফলে স্মৃতিশক্তি উন্নত হয়।বই মানুষের চিন্তার দক্ষতা বাড়ায়। নিয়মিত বই পড়ার ফলে সৃজনশীল লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। বই পড়া বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার আগে, এই বই ই ছিল সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম।
বই পড়ার ফলে কল্পনা শক্তি বৃদ্ধি পায়, এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন “একজন লেখক যতটা খাতা-কলমে লিখে, তার চেয়ে বেশি লিখে মনে মনে।”
লেখকদের কল্পনা শক্তি তীক্ষ্ণ। তবে এই কল্পনা শক্তির জন্ম কোথায়? – বই পড়ায়। বই পড়ার ফলে মানসিক ব্যায়াম হয়। বই পাঠকের মানসিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, অধ্যয়ন ডিমেন্সিয়া ও আলজেহিমা নামের এই রোগ দুটিকে হ্রাস, এমনকি প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে। মস্তিষ্ককে সচল রাখলে তা কখনোই তার ক্ষমতা হারাবে না। মস্তিষ্ককে শরীরের একটি সাধারণ পেশি হিসাবে বিবেচনা করে বই পড়া চর্চার মাধ্যমে নিয়মিত ব্যায়াম করলে তা শক্তিশালী ও সজীব থাকে।একটি বই পুরনো হয়ে গেলেও তার ভেতরে থাকা জ্ঞান বা তত্ত্ব কখনোই পুরনো হয় না তা থাকে চির নবীন।
এ প্রসঙ্গে পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম তার রুবাইয়াত কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন :
”রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে
বই, সেতো অনন্ত যৌবনা।“
সুতরাং আমাদের বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে এবং একমাত্র বই পড়ার মাধ্যমে এই জাতির অনন্ত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যেতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।