মো: কামরুজ্জামান, জেলা প্রতিনিধি : বোরো ধান ফলনের ধারণা বদলে দিয়েছে নতুন জাতগুলো। ধান উৎপাদনে সর্বাধিক উৎপাদনশীল মৌসুম বোরো। এ কথা অনস্বীকার্য, বোরোর ওপর ভিত্তি করেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি রচিত হয়েছে। কারণ দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৫৮ শতাংশ আসে এ মৌসুম থেকে। তাই গ্রাম-বাংলার প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে বোরো মৌসুমে বেড়েযায় বোরো কেন্দ্রিক ব্যস্ততা। পাকা ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই, শুকানো, সিদ্ধ করা, ঘরে তোলাসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন কিষান-কিষানিরা।
সকাল থেকেই জমিতে ছুটেন কৃষকরা, বাড়িতে গৃহিণীরা ব্যস্ত উঠান পরিষ্কার করে ধান রাখা, মাড়াই, শুকানো, সিদ্ধ করা ও সংরক্ষণের কাজে। এ যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ! উঠান বা আঙিনাজুড়ে শুধু ধান আর ধান। কারও বাড়ির উঠান টইটম্বুর হয়ে গেছে সোনালি ধানে। পাকা ধানের ঘ্রাণে ম ম করছে চারদিক। রাশি রাশি সোনালি ধান সংরক্ষণে কেউ গাছের ছায়ায় বসে ধান তোলার কাজে ব্যবহার্য পুরোনো ধামা, পইয়া, তাফাল, গোলা ঠিক করছেন।এবার ২০২৪-২৫ সালে বোরো ফলনের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গতো ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাতক্ষীরা জেলার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৯ হাজার৭৮০ হেক্টর জমি। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪ লক্ষ ৮৬ হাজার ৬৫৮ মেঃটন, সাতক্ষীরা সদর উপজেলা লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমি এবং কলারোয়া উপজেলার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমি। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো: ইয়াছির আরাফাত জানান চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বোরো ধান নির্বিঘ্নে শতভাগ কৃষকেরা ঘরে উঠেতে পারবেন।
এতদিন ধরে বোরোর সেরা জাত ছিল ব্রি উদ্ভাবিত ব্রি ধান-২৮ ও ব্রি ধান-২৯। ১৯৯৪ সালে উদ্ভাবিত এ দুটি বোরো জাত দেশের মোট বোরো এলাকার প্রায় ৭০ শতাংশ দখল করে ছিল। অনেক বিকল্প জাত উদ্ভাবিত হলেও দীর্ঘদিন ধরে বোরো আবাদে কৃষকের বড় একটি অংশের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জাত ছিল ব্রি ধান-২৮ ও ২৯। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আবাদ হওয়া এ জাত দুটির রোগবালাই সহনশীলতা ক্রমেই হ্রাস পাওয়ায় স্থানীয় কৃষকদের আবাদে নিরুৎসাহিত করছে কৃষি বিভাগ।
পাশাপাশি ব্রি উদ্ভাবিত বিকল্প জাত বিএলবি প্রতিরোধে ব্রি-৩৫,৩৬ লবণ সহিষ্ণু ব্রি-৬৭ উচ্চ ফলনশীল ব্রি- ৮৮, ৮৯, ৯২, ৯৯ও ব্রি ধান-১০০ জিংক সমৃদ্ধ ব্রি-১০২ সহ কয়েকটি জাত চাষ করার পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ । রোগবালাই সহনশীল ও উচ্চ ফলনের কারণে ২০১৮ থেকে ২০২১ সালে উদ্ভাবিত এ জাতগুলোর প্রতি কৃষকের আস্থা ক্রমেই বেড়েছে। এবার মাঠে কৃষকের মাঝে ভালো সাড়া ফেলেছে এ বারোটি বোরোর নতুন জাত। কৃষকরা বলছেন, এ জাতগুলোর ফলন আশাতীত ও অভাবনীয়।
কৃষকের বোরোর ফলনের ধারণা বদলে দিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত নতুন এসব জাত। এবার এলাকাভেদে নতুন জাতগুলোর গড় ফলন ছিল বিঘাপ্রতি ২৮-৩৩ মন। কোথাও কোথাও আরও বেশি ফলনের রেকর্ড রয়েছে। এতদিনের কাঙ্ক্ষিত সেই বিকল্প জাত এখন কৃষকের হাতে হাতে। এসব জাতের কয়েকটি মাঠ দিবসে আমারও অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। সরাসরি কথা হয় অনেক উচ্ছ্বসিত কৃষকের সঙ্গে। গিয়েছিলেন ফসল কর্তন অনুষ্ঠানে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতেই এ লেখার অবতারণা।
সাতক্ষীরা কলারোয়া উপজেলার ইলিশপুর গ্রমের কৃষক কবিরুল ইসলাম ডাবলু জানান ২০২৩-২৪ বোরো মৌসুমে ৫ বিঘা জমিতে ব্রি-১০২ বোরো ধানের চাষাবাদ হয়েছে। যা বিঘা প্রতি ২৯ মন ধান পাওয়া গিয়েছে। তিনি আরো জানান এবছর ১৪ জন চাষি ৪০ বিঘা জমিতে ব্রি-১০২ ধার আবাদ করবেন বলে আগাম বীজ সংগ্রহ করেছেন। তিনি আরো বলেন আগে আমাদের এখানে ৩৩ শতাংশের ২৩-২৪ মন ধান পেতাম ব্রি-২৮ ধানের আবাদ করে। এখন নতুন জাত আসাতে বিঘা প্রতি ২৯-৩০ মন ধান উৎপাদন হচ্ছে।
একটা সময় পরিশ্রম বেশি হওয়ায় ধান চাষে কৃষকের অনীহা দেখা যেত, কিন্তু এখন সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও প্রণোদনা সহায়তার কারণে কৃষক পতিত জমিতে ধান চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছে। নতুন জাতের ধানের ফলন ভালো হওয়ায় বেশ লাভবান হচ্ছে।’ কলারোয়া উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের কৃষক বেল্লাল হোসেন বলেন, ‘ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাতক্ষীরা আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে সফল ফর আই ডাব্লিউ আরএম প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রি ধান- ৮৮ এর বীজ পায়। দারুণ ফলন পেয়েছি। বিঘায় প্রায় ৩০ মন। এ জাতের ধানে রোগবালাই ও কম।
গত ২ মে মাসে গিয়েছিলাম সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার যুগিখালী গ্রামে ব্রি উদ্ভাবিত এসব নতুন জাতের মাঠ দিবস অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের ফাঁকে কথা হয় কৃষক আব্দুল গফুর ফকিরের সঙ্গে। তিনি এ বছর ব্রি ধান-২৮ ও ২৯-এর পরিবর্তে ব্রি ধান-৮৮, ৯২ ও ব্রি ধান-১০০ আবাদ করেছেন পাঁচ বিঘা জমিতে। কৃষক গফুর জানান, ‘পাঁচ বিঘা জমিতে আমি এসব ধান চাষ করে আগের চেয়ে প্রতি বিঘায় অন্তত ১০-১২ মন বেশি ফলন পেয়েছি। তাছাড়া খরচও লেগেছে অনেক কম।’
জেলার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের কৃষক ইউনুস আলী বলেন, ‘আমার বয়সে এ জাতের মতো ফলন আর কোনো জাতে পাইনি। বাম্পার ফলন হয়েছে ব্রি ধান-৮৮,৮৯, ৯২ ও ব্রি ধান-১০০, ১০২ জাতে। এ জাতের চাল চিকন। বাজারে ভালো দাম পাব বলে আশা করছি। এ তিন জাতের ধান চাষে পানিও কম লাগে, কীটনাশক লাগে না বললেই চলে।’
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কাশেমপুর গ্রামের কৃষক আমানউল্লাহ তিনি জানালেন, ‘ধানের নতুন জাত ব্রি ধান-৮৮, ৯২ চাষ করে প্রতি বিঘায় ফলন পেয়েছি২৯ থেকে ৩৩ মন, যা কল্পনাতীত। এ জাতের ধান চাষে পানি কম লাগে, কীটনাশক লাগে না বললেই চলে, কিন্তু ব্রি ধানের নতুন জাত আমার ধারণা বদলে দিয়েছে।