সবুজ হোসেন: ঢাকা বর্তমানে পৃথিবীর ১৩তম মেগা সিটি হিসেবে পরিচিত। মেগা সিটি হিসেবে বিবেচিত হয় এমন শহরগুলোর জনসংখ্যা ১০ মিলিয়ন (১ কোটি) বা তার বেশি। ঢাকায় বর্তমানে প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস, এবং এটি দ্রুত বর্ধনশীল। এই বর্ধনশীল মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা সমস্যা। ফলে ধীরে ধীরে বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বসবাস অনুপযোগী হওয়ার সবগুলো সূচকের মধ্যে এটি সব সময়ই শীর্ষে অবস্থান করে । এদের মধ্যে শব্দ দূষণ অন্যতম।।
শব্দ দূষণ হল শব্দ বা শব্দের প্রচার যা মানব বা প্রাণী জীবনের কার্যকলাপের উপর বিস্তৃত প্রভাব ফেলে, যার বেশিরভাগই কিছুটা ক্ষতিকারক। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭-এ শব্দদূষণকে এক ধরনের পরিবেশ দূষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এখানে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দিনে ৫০ ডেসিবেল এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল এর বেশি হলে তা শব্দদূষণ হিসেবে গণ্য হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন বা নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষের জন্য ঘরের ভেতর শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় গ্রহণযোগ্য মাত্রা দিনে ও রাতে ৫৫:৪৫,বাণিজ্যিক এলাকায় ৬৫:৫৫,হাসপাতাল এলাকায় ৫০:৪০, শিল্প এলাকায় ৭৫:৬৫। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে ঢাকায় শব্দ দূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়কে হর্ন বাজানোসহ যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, মাইকের অসতর্ক ব্যবহার, লাউড স্পিকারের ব্যবহার, বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার, শিল্পকারখানা, উড়োজাহাজ, ট্রেন, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, ঘনবসতি এলাকা হওয়ায় মানুষের কোলাহল, রাস্তায় যানজট ও বিনোদনমূলক কর্মকান্ড।
অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা গেছে, উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চ শব্দ মানুষের ঘুমেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
শব্দদূষণে অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। উচ্চ শব্দে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ ও উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যা দেখা দিতে পারে সব বয়সের মানুষেরই। তবে বিশেষভাবে ক্ষতি হতে পারে শিশুদের। দিনের পর দিন শব্দদূষণের শিকার শিশুদের মনোযোগ দেওয়ার ও কিছু পড়ার ক্ষমতা লোপ পেতে পারে।সারা বিশ্বে ৫% ও বাংলাদেশে ১২% মানুষ শ্রবণ সমস্যায় ভুগছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা যায় ১১% ট্রাফিক পুলিশ শ্রবণ সমস্যায় ভুগছে। ৬১% মানুষ শব্দ দূষণের জন্য হতাশা ও উদ্বেগের মতো সমস্যায় ভুগে। অতিরিক্ত শব্দ স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, মানসিক অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়। শব্দ দূষণ রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে যেমন : সচিবালয়কে নো হর্ণ জোন ঘোষণা করা হয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ক্ষমতা বলে, ২০০৬ সালে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।মহান্য হাইকোর্ট ২০০২ সালের ২৭ মার্চ প্রকার যানবাহন থেকে হাইড্রলিক হর্ন ও বিরক্তিকর হর্ন নিষিদ্ধ করে।বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ অনুসারে, শব্দদূষণ একটি দণ্ডণীয় অপরাধ। প্রথমবার অপরাধের জন্য অনধিক এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভদণ্ড। আর পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভদণ্ড হতে পারে। এই আইনের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দ দূষণ রোধ করা সম্ভব। শব্দ বায়ু দূষণ প্রতিরোধের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। প্রথমেই যানবাহনের শব্দকে নিয়ন্ত্রণ করা। যানবাহন থেকে যাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হর্ন বাজানো না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। শিল্প কলকারখানার শব্দ নিয়ন্ত্রন করা। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা যেমন: শব্দ দূষণ রোধ করার শব্দদূষণ শীর্ষক বিভিন্ন সেমিনার এবং সভা করার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা যায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।