এইচ. এম. মশিউর রহমান: দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতির এই বিপর্যয়ের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন আজ প্রায় যন্ত্রণার তলানিতে এসে ঠেকেছে। মানুষ দ্রব্যমূল্য নামক এই মানব সৃষ্ট অত্যাচারের ফলে এখন আর শ্বাস নিতে পারছে না। কোন রকম নাক উঁচিয়ে বেঁচে আছে। মানুষের সাধারণ জীবন মান একদমই সাধারণ নেই তা অত্যান্ত কষ্ট অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। মানুষ আর এই অত্যাচার নিতে পারছে না। মানুষ কোন রকম খেয়ে না খেয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। মনে হচ্ছে যেন মানুষের এই কষ্ট দেখার কোথাও কেউ নেই সব যেন ঘুমিয়ে আছে কোন প্রকার জাগরণের প্রাথমিক চিহ্নটুকুও নেই উপর মহলের। নিম্ন আয়ের মানুষ যারা আছে তাদের জীবনের যে বেহাল দশা তা স্বচক্ষে না দেখলে সেই কষ্টের আঁচ অনুভব করা যায় না। প্রতিটি জিনিসের দাম প্রায় তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। কেউ কেউ এক বেলা খাচ্ছে অন্য বেলা না খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে। মানুষ কার কাছে বলবে কোথায় গিয়ে এই বেদনার উদগীরণ করবে সেই পরম কোন আশ্রয় যেন মানুষের কোথাও নেই। সব কিছু কেমন যেন ছন্নছাড়া বেখাপ্পা ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। মানুষের দুঃখ শোনার মত কোথাও যেন কেউ নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট নামক একদল দালাল গোষ্ঠী যারা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী তাদেরকে কোন ভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। তাদের কাছে যেন সাধারণ মানুষ এক প্রকার বন্দী। আকাশছোয়া মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষ আজ দিশেহারা।
আমাদের দেশে দীর্ঘ সময় ধরে পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা যায়। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পরিবহন খরচ বৃদ্ধি করে। পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, বন্যার কারণে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস পেলেও দাম বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক মন্দার সময় বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, মানুষের আয় কমে যায়, চাহিদাও কমে যায়। কিন্তু সরকার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তার ফলে বাজারে অর্থের সরবরাহ বৃদ্ধি পায় এবং পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও সেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। অসৎ ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে থাকেন।
বর্তমান সময়ে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে নামিদামি পত্রপত্রিকা কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে যে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে সেটি হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এমন অস্বাভাবিক, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং আকস্মিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনধারণ ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। তাদের কাছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন নতুন এক অভিশাপের নাম! এভাবে চলতে থাকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়বে। জীবনের হয়ে উঠবে জীবন নামক জেলখানা।
দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির কারণ হচ্ছে ব্যবসায়ীদের অত্যধিক হারে মুনাফা লাভের আসক্তি, অবৈধভাবে যে কোনো পণ্যের মজুত বৃদ্ধি, খাদ্যদ্রব্য কিংবা বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল ও জ্বালানি সংকট, ন্যায়সংগত ও নির্ধারিত মূল্য নির্ধারণ না করা, বাজার তদারকিতে অনীহা ইত্যাদি। তবে এই বিষয়গুলোর সঙ্গে গ্যাস, তেল ও বিদ্যুতের সংকট কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে অনেকাংশে কঠিন করে তুলেছে। চলমান যুদ্ধের কারণে তেল আমদানিতে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এমনকি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে অযাচিতভাবে! বর্তমানে এই অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম যেন ক্রমাগত বেড়েই চলছে। তাদের যেন কেউ বলার নেই ধরার নেই। কব্জা করে রেখেছে মানুষের জীবন।
দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতি চলতে থাকলে অতি দ্রুত আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই এখনই সরকারকে যুগোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমে যে কাজটি করা দরকার বলে মনে হয় তা হচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থাৎ দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান যেমন টিসিবি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে দ্রব্যমূল্যের আকস্মিক পরিবর্তন ঘটানো দুষ্কৃতকারীদের মূলউৎপাটন করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে অবৈধভাবে অধিকহারে পণ্য মজুত করতে না পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি আমদানি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। পচনশীল খাদ্যপণ্যের যথাযথ সংরক্ষণের জন্য উপজেলাভিত্তিক হিমাগার স্থাপন করতে হবে। দেশে সংরক্ষণের অভাবে বছরে ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়। ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাপ কমাতে এটি অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। অপচয় রোধ করার পাশাপাশি সরকার প্রধানের নির্দেশনা মোতাবেক এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। মূলত আমরা যদি আমাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উত্পাদনে সচেষ্ট হই, তবে একদিকে যেমন আমদানির প্রবণতা কমে আসবে, ঠিক তেমনি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের অসৎ উদ্দেশ্যও নস্যাৎ হবে। মনে রাখতে হবে, বাজার নিয়ন্ত্রণের সামগ্রিক বিষয় আমাদের হাতে থাকে না বটে, কিন্তু আমরা যদি সচেতন হই, তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিম্নগামী হতে বাধ্য।
বাংলাদেশের মত দুর্বল অর্থনীতির দেশে দ্রব্যমূল্যের এমন বৃদ্ধি এক বিশাল বড় সমস্যা। ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করছে নিজেদের স্বার্থে। দ্রব্যমূল্য একবার বেড়ে গেলে তা আর নিয়ন্ত্রণে আসে না। এটা নিয়ে সরকারি বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করলেও কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। রাষ্ট্র এবং সরকার জনগণ সকলকে এক সাথে এই কালোহাতকে প্রতিহত করতে হবে।
আমরা যদি এখনই এই অসাধু ব্যবসায়ী ও অসাধু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে জড়িত সিন্ডিকেট নাম উপগোষ্ঠীকে রুখে দিতে না পারি তাহলে আমাদের জন্য ভবিষ্যৎ সময়ে আরো চরম মূল্য দিতে। ধীরে ধীরে তারা সকল কিছু গ্রাস করে নিবে সকল কিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে আর যদি এভাবে সকল কিছুকে তারা গ্রাস করে নেয় তাহলে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা হয়ে পড়বে এক দুঃস্বপ্নের মতই পীড়াদায়ক। তাই এখনই আমাদের সকলকে এই বিষয়ে সচেতন হবে এবং রাষ্ট্রের এই সকল বিষয়ে প্রচন্ড গুরুত্বের সাথে বিবেচনাপূর্বক ব্যবস্থা নিতে হবে তাহলে কেবল আমরা এই দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নামক এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
লেখক : আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।