The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ঢাবির মুহসীন হলে রাতভর নির্যাতন, ২০১৭ সালের ঘটনায় ১৩ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০১৭ সালে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে ইসলামিক পেজে লাইক দেওয়ায় শিবির সন্দেহে পাঁচ শিক্ষার্থীকে রাতভর ভয়াবহ নির্যাতনের মাধ্যমে রক্তাক্ত করে হল ছাড়া করা হয়। এ ঘটনায় ১৩ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের হয়েছে।

ঘটনার দুই ভুক্তভোগী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মাসরুর ও একই সেশনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী বাপ্পী মিয়া পৃথক দুটি মামলা করলে গত ২ সেপ্টেম্বর শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম সাহাবুদ্দিন শাহীন (পিপিএম) এ মামলা গ্রহণ করেন।

উভয় মামলার আসামিরা হলেন- হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. জহিরুল ইসলাম ওরফে সরকার রায়হান জহির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক আইনবিষয়ক সম্পাদক মো. সাইফুর রহমান (বর্তমান সেকশন অফিসার, রেজিস্ট্রার বিল্ডিং, যবিপ্রবি), মুহসীন হল ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান (সানী), হল ছাত্রলীগের সাবেক শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক এসএম খালেদ চৌং ওরফে এসএম খালেদ চৌধুরী (৪১তম বিসিএস অডিট ক্যাডারে কর্মরত), সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ আশিকুর রহমান (বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক), হল ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক মেহেদী হাসান মিজান (বর্তমানে গাইবান্ধার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক), সাবেক সহসম্পাদক হাসিবুল আলম সৌরভ, সাবেক ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মো. শাহাদাত হোসেন ওরফে সোহেল, সাবেক পাঠাগার সম্পাদক শেখ আরিফুল ইসলাম, সাবেক সাংগঠনিক ইমতিয়াজ ওরফে ইমতিয়াজ আহমেদ শুভ্র (বর্তমানে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থানার এসআই), সাবেক সহসম্পাদক নাঈম আহমেদ, সাবেক উপ-ছাত্র ও ছাত্রবৃত্তি সম্পাদক মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দিন (সম্প্রতি ধর্ষণের অভিযোগে আলোচিত) এবং সাবেক উপ-প্রচার সম্পাদক ইমরান হাসান।

আবদুল্লাহ আল মাসরুর তার মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, আমি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের একজন নিয়মিত আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলাম। একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে হলে আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে বসবাসরত ছিলাম। নিয়মিত পড়াশোনায় মগ্ন থেকে নিজের একাডেমিক ক্যারিয়ার ও বাবা-মায়ের মানুষের মতো মানুষ হওয়ার আশা পূরণে রাজনীতিমুক্ত থেকে পড়াশোনা করতাম। হলে থাকায় বাধ্য হয়েই ছাত্রলীগের গণরুম ও গেস্টরুম নামক অত্যাচারের বেড়াজালে অন্যদের মতো আমিও জিম্মি ছিলাম। গত ১৬ আগস্ট ২০১৭ ইং দিবাগত রাত ১১টা থেকে ১৭ আগস্ট ২০১৭ প্রথম প্রহর পর্যন্ত আসামিরা আমার ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। রাতটির এ সময় ছিলো আমার ও আমাদের কয়েকজন শিক্ষার্থীর জীবনের সবচেয়ে বর্ণনাতীত ভয়াবহ রাত। আমি সে রাতটিকে নিজের জীবনের শেষ রাত হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। আবরার ফাহাদ, হাফিজ অথবা আবু বকরের মৃত্যুর মতো আমার মৃত্যু নিয়েও হয়তো নিউজ হতো, ছাত্রসমাজ সোচ্চার থাকত। আমরা যারা সাধারণ, সহজ সরল, ভদ্র ও নামাজ কালাম পড়তাম তাদের টার্গেট করে এই হত্যাচেষ্টা সংগঠিত হয়। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার জন্য ‘শিবির ট্যাগ’ ব্লেইম দিয়ে এসএম খালেদ চৌধুরী, সৈয়দ আশিকুর রহমান, মেহেদী হাসান মিজান, শেখ আরিফুল ইসলাম, ইমতিয়াজ, শাহাদাত হোসেন সোহেল ও ইমরান হাসান আমিসহ অন্য ভিকটিমদের নামের লিস্ট করে তৎকালীন মুহসীন হল ছাত্রলীগ সভাপতি মো. জহিরুল ইসলাম (সরকার রায়হান জহির), সেক্রেটারি মেহেদী হাসান সানী ও ঢাবি ছাত্রলীগের আইন সম্পাদক মো. সাইফুর রহমানের নিকট প্রেরণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার রাতে এসএম খালেদ চৌধুরী আমার রুমে গিয়ে ডাকতে থাকে। তখন আমি এশার নামাজ আদায় করা অবস্থায় ছিলাম। নামাজ শেষ করতেই খালেদ আমার মোবাইলের পাসওয়ার্ড চেয়ে নিয়ে আমার মোবাইলের তথ্য ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চেক করতে থাকে। সেসময় সে মোবাইল চেক করতে করতে আমাকে অত্যন্ত বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করে। আমি আমার অপরাধ কি জিজ্ঞেস করলে সে ক্ষেপে গিয়ে আমাকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে, সঙ্গে আমাকে মারতে যোগ দেয় মেহেদী হাসান মিজান, শাহাদাত হোসেন, শেখ আরিফুল ইসলাম, সৈয়দ আশিকুর রহমান, ইমতিয়াজ, ইমরান হাসান। তারা আমাকে টেনেহিঁচড়ে ছাত্রলীগ সভাপতি সরকার রায়হান জহিরের রুমে নিয়ে যায়। তখন আমি গিয়ে সে রাতের আরেক ভিকটিম বাপ্পী মিয়াকে তার শরীরের রক্তের উপর শায়িত হয়ে প্রায় অচেতন অবস্থায় দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে যাই। তার হাত-পা ভাঙা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে এবং ব্যথার যন্ত্রণায় তার আর্তচিৎকার দেখে আমি আঁতকে উঠি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে সেই রুমে থাকা জহিরুল ইসলাম, মেহেদী হাসান সানী ও সাইফুর রহমান বলে ওঠে, ‘এই শুয়োরের বাচ্চা শিবির, দেখ তার মুখে দাড়ি আছে, সে মাদ্রাসায়ও পড়েছে’। এই বলে তারা আরেক ধাপে আমার অ্যান্ড্রয়েড ফোন খুঁজে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তল্লাশি চালায়।

মাসরুর বলেন, বিভিন্ন ইসলামি পেইজ ও ইসলামিক ব্যক্তিত্বদের প্রোফাইলে লাইক ও কমেন্ট পায়। ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে পোস্ট করা, ভিডিও শেয়ার করা, সিভিল সোসাইটির বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী-বিজ্ঞজনদের পোস্ট শেয়ার করা, আমার সাবেক মাদ্রাসার ক্লাসমেটদের নিয়ে একটি গ্রুপ পায়। ড. আসিফ নজরুল, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক ড. তানজীম উদ্দীন খানসহ অন্যান্য বিজ্ঞজনদের ছবি ও পোস্টে কমেন্ট পায় ইত্যাদি অপরাধে জহির, মেহেদী হাসান সানী ও সাইফুর আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে এবং এই তিনজনে মিলে আমাকে পালাক্রমে বড়, লোহা সদৃশ ধাতব বস্তু, জিআই পাইপ ও স্ট্যাম্প দিয়ে আমার হাত, পা, পিঠে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। তারা রগ কাটার জন্য পাশের রুম থেকে ছুরি নিয়ে আসে। চিৎকার যাতে বাইরে না যায় তার জন্য উচ্চশব্দে সাউন্ড বক্স মিউজিক বাজিয়ে দেওয়া হয়। আমাকে মারতে মারতে একজন ক্লান্ত হয়ে পড়লে আরেকজন আসে, সে জিরিয়ে নিলে আরেকজন আসে এভাবে দীর্ঘসময় যাবৎ আমাকে মারতে থাকে। উপর্যুপরি রড ও অন্যান্য বস্তু দিয়ে মারার ফলে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করে। আমার শরীরের রক্ত চুইয়ে টপ টপ করে পড়তে থাকে। আজরাইল আসন্ন মনে করে আমি কালেমা পড়তে থাকি। তখন বেশ কয়েক দিন যাবত অসুস্থ ছিলাম; তারপরও আমার কাকুতি মিনতি পাষণ্ডরা শোনেনি। এক পর্যায়ে আমি প্রচণ্ড ব্যথায় অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হই। তখন আমি আমার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র দোহাই দিয়ে আশিকুর রহমানের পায়ে ধরে প্রাণ ভিক্ষা চাই। তৎক্ষণাৎ সে আমাকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। এরপর খালেদ চৌধুরী, ইমতিয়াজ, আশিকুর রহমান, শেখ আরিফুল ইসলাম, মেহেদী হাসান সানী, শাহাদাত হোসেন সোহেল, ইমরান হাসান এলোপাতাড়িভাবে হাত, পা ও স্ট্যাম্প নিয়ে আমাকে প্রচণ্ড মারধর করে জোরপূর্বক বিভিন্ন স্বীকারোক্তি আদায় করে।

এজাহারে আরও বলা হয়, তারা সবাই বলে ‘এই বাইনচোত, মাগির বাচ্চাকে ছাদ থেকে ফেলে দে। এই শিবিরকে জানে মেরে ফেলতে হবে।’ পিটুনির মাথায় আল্লাহ গো, মা গো বলে চিৎকার দিতে থাকলে তারা বলে তোর বাবা-মা আমরাই, এবার আরও ডাক বলে আরও সজোরে মারতে থাকে। এরই মধ্যে শাহাদাত হোসেন সোহেল একটি ছুরি নিয়ে এসে আমার জিহ্বা টেনে বের করে কেটে ফেলতে চায় এবং ছুরি চালায়, এতে করে আমার জিহ্বার সামান্য অংশ কেটে গিয়ে রক্ত বের হয়। তাদের কয়েকজন আমার পায়ের রগ কাটতে উদ্যত হয়। এভাবে আরও নানা মধ্যযুগীয় কায়দায় হাসি-ঠাট্টার ছলে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন অশ্লীল কথার আদান-প্রদান করে তারা আমার উপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায়। ইতোমধ্যেই তারা আমার সঙ্গে থাকা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয় যার নেতৃত্বে ছিল এসএম খালেদ চৌধুরী, মো. সাইফুর রহমান, জহিরুল ইসলাম, মেহেদী হাসান সানী, সৈয়দ আশিকুর রহমান।

মাসরুর বলেন, আমার মতো একই কায়দায়, একই ধরনে, একই মাধ্যমে আসামিরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বাপ্পী মিয়া ও মেহেদী হাসান, মনোবিজ্ঞান বিভাগের ইব্রাহিম হোসেন (ইরফান) এবং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আবদুল গাফফারকে উল্লেখিত একই পাতানো অপরাধে মেরে রক্তাক্ত করে। এতে তাদের কয়েকজনের হাত-পা ভেঙে যায়। তারাও আমার মতো মর্মান্তিক পরিণতি ভোগ করে।

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম সাহাবুদ্দিন শাহীন বলেন, আমরা ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে সংঘটিত নির্যাতনের ঘটনার দুটি মামলা পেয়েছি। এগুলো নিয়ে কাজ চলমান।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.