‘বিচার বিভাগেই নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাই’
হেদায়েতুল ইসলাম নাবিদ: পুরো নাম রাকিব মাহমুদ। জন্ম বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল এরিয়ায়। মা-বাবা আর ছোট এক বোন নিয়ে রাকিবের ছোট পরিবার। তিনি স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-২০১৭ বর্ষের শিক্ষার্থী। বাবা পেশায় একজন ব্যবসায়ী এবং মা গৃহিণী। ছোট বোন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে কখনো জজ হওয়ার স্বপ্ন ছিল না আমার। ক্যাম্পাস জীবনের প্রথমদিকে পড়ালেখা নিয়ে কিছুটা বেগ পেতে হয়। বিভাগে আট সেমিস্টারের মধ্যে ছয় সেমিস্টারে রেজাল্ট ছিল সেকেন্ড ক্লাস। পরবর্তীতে যখন নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম তখন বিজেএস এক্সামের দিকে নজর পড়ল এবং ঠিক করে ফেললাম যে জজ হওয়াটাই আমার জন্য বেস্ট অপশন হবে। কথাগুলো এইভাবেই বলেছিলেন উদ্যমী রাকিব।
রাকিবের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট:
একদিন বিজেএস নিয়েই কথা বলতে গিয়ে খুব কাছের একজন আমাকে বলেছিলো আমি প্রিলিতেও টিকতে পারবো না। সেদিন আমার নিজেকে খুব নিচু মনে হয়েছিল এবং একটা জিদ কাজ করেছিল। সেইদিন সেই মানুষটাকে বলেছিলাম আমি জজ হবই। এই মানুষটার কাছে আমি কৃতজ্ঞ কারণ তাঁর ঐ কথাটা আমার মধ্যে জিদ তৈরি করে দিয়েছিল।
এরপর আমি প্রস্তুতি শুরু করি। যেহেতু অ্যাকাডেমিকালি প্রথম ছয় সেমিস্টার অনেক ফাঁকি দিয়েছিলাম সেহেতু আমাকে প্রথমে বেসিক ঠিক করার জন্য পড়াশোনা করতে হয়েছে। ২১ সাল থেকে আমি নিজেকে একপ্রকার সবকিছু থেকে আইসোলেটেড করে ফেলেছিলাম প্রস্তুতির জন্য। ১৫শ বিজেএস এক্সাম আমার জন্য প্রথম ছিল। সদ্য এলএলবি শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ করে প্রিলি এক্সাম দিয়েছিলাম। ভাইভা ফেইল করে ব্যর্থ হই। চূড়ান্ত ফলাফলের পরে ভেঙে পড়েছিলাম, মানসিক অবসাদে ভুগতাম।
পরবর্তীতে প্রফেশনাল হেল্প, মেডিকেশন নিয়ে একটু স্বাভাবিক হয়ে আবার পড়াশোনা শুরু করি। ১৫শ বিজেএসের চূড়ান্ত ফলাফলের দুই মাসের মধ্যে ১৬শ বিজেএসের প্রিলি এক্সাম হয়। প্রিলিমিনারি ও পরবর্তীতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভাইবার জন্য মনোনীত হয়। সেইবার প্রস্তুতি নিয়ে ভাইবা বোর্ডে আমার সর্বোচ্চটা দেই। চূড়ান্ত ফলাফলের পর ১৬শ বিজেএস এক্সামে আমি সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়।
জজ হয়ে রাকিবের অভিব্যক্তি:
আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আমি উপভোগ করেছি। আড্ডা দিয়েছি, বন্ধুদের সাথে ঘুরেছি, সাহিত্যের বই পড়েছি আবার সময়মত নিজের ক্যারিয়ারেও ফোকাস করেছি। বিভাগের শিক্ষকদের কাছেও কৃতজ্ঞ। প্রস্তুতি এবং এক্সামের সময় উনারা অনেক নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সাহস যুগিয়েছিলেন। বিভাগে আমার কিছু বন্ধু এবং জুনিয়র ছিল যারা আমাকে সবসময় সাপোর্ট দিয়ে গেছে।
ফলাফল প্রকাশের পরে আমি একটা ঘোরে ছিলাম। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না। বাবা-মাসহ দাদাবাড়ি এবং নানাবাড়ির প্রতিটা মানুষ অনেকবেশি খুশি। নিজের হাইস্কুল থেকেও আমি প্রথম সুপারিশপ্রাপ্ত জজ। এজন্য হাইস্কুলের বন্ধুরাও অনেকবেশি খুশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বিভাগ থেকে ১৬শ বিজেএস আমি একমাত্র সুপারিশপ্রাপ্ত। এজন্য বিভাগের সকলেও আমার উপরে সন্তুষ্ট।
জুনিয়রদের জন্য রাকিবের পরামর্শ ও উপদেশ:
জীবনে পরিশ্রম আর সাথে একটু ভাগ্য থাকলে নিজের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব। আমাদের কাজে কনসিসটেন্সি থাকলে লক্ষ্য একসময় পূরণ হয়। মাঝপথে হাল ছেড়ে দিলে লক্ষ্য থেকে যোজন যোজন দূরে চলে যেতে হয়।
জীবনে আসলে চূড়ান্ত ফলাফল বলে কিছু নেই। দুই একটা একাডেমিক ফলাফল আমাদের জীবনকে থামিয়ে দিতে পারে না। আবারও ঘুরে দাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে দিয়ে দেন। আমাদের করণীয় হলো সেই সুযোগটা কাজে লাগানো। আমাদের যেকোন ব্যর্থতার পরে আমরা অনেক ধরনের কথা শুনে থাকি, অন্যের কাছে অপমানিত হই। এ ধরণের কথা কাজে মন দিলে চলবে না। নিজের কাজ, নিজের জীবন নিজেকেই গুছিয়ে নিতে হবে।
ক্যারিয়ার নিয়ে রাকিবের ভাবনা:
বিচার বিভাগেই নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাই। নিম্ন আদালতে ভবিষ্যতে যদি নিজেকে প্রমাণ করতে পারি তবে উচ্চ আদালতের বিচারক হওয়ার স্বপ্ন আছে। সবসময় ন্যায়ের সাথে, ন্যায়ের পথে থাকতে চাই।
অন্য কোন ক্যারিয়ারের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই।
তবে আমি স্ট্রিট অ্যানিম্যালদের (স্ট্রিট ডগ, ক্যাট) কষ্টটা অনেক অনুভব করি। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন জব পাওয়ার পরে এদের জন্য ছোট পরিসরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হলেও কিছু করার।