সোহানুর রহমান, রাবি প্রতিনিধিঃ পদ্মাবিধৌত উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ ও দেশের দ্বিতীয় সর্বচ্চো বিদ্যাপীঠ, হাজারো শিক্ষার্থীর প্রাণের স্পন্দন, ৭৫৩ একরের ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এ অঞ্চলের উচ্চশিক্ষার বাতিঘর দীপ্তি ও সাফল্যের ৭০ পেরিয়ে ৭১ এ পদার্পণ করলো। উত্তরবঙ্গের পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলোয় সমৃদ্ধ করতে ৬ জুলাই ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে যাত্রা শুরু করে মতিহারের সবুজে স্বমহিমায় ভাস্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
রাবি প্রতিষ্ঠার ইতিহাসঃ
শহীদ ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতি বিজড়িত দেশের শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠের রয়েছে গৌরব-ঐতিহ্যের সুদীর্ঘ ইতিহাস।ব্রিটিশ আমলে রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা-দীক্ষার উন্নয়নের জন্য ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজ। সে সময় রাজশাহী কলেজে আইন বিভাগসহ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শ্রেণি চালু করা হয়। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তখনই রাজশাহীতে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজন অনুভূত হয়।
১৯৪৭ সালে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে এ অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫০ সালে রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি হয়। ১৯৫২ সালে শহরের ভুবনমোহন পার্কে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে জনসভা হয়। অনেক আন্দোলনের পর তৎকালীন আইনসভার সদস্য মাদার বখশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় পাস হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন। নতুন উপাচার্য প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরীকে সঙ্গে নিয়ে মাদার বখশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এ দু’জনকে যুগ্ম সম্পাদক করে মোট ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। একই বছরের ৬ জুলাই প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য নিয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। শুরুতে ১৬১ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক :
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতীকে রয়েছে একটি বৃত্ত যা বিশ্বের প্রতীক, একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ যা জ্ঞানের প্রতীক এবং আকাশ দৃষ্টি শাপলা ফুল যা সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও জাতীয়তার প্রতীক এবং একটি সূর্য যা প্রাণ ও শক্তির উৎস। প্রতীকের বৃত্ত ও মূল গ্রন্থ কোবাল্ট ব্লু যা আকাশ, নদী ও উদারতার রং।গ্রন্থের বহি:রেখা রক্তলাল, জাতীয় পতাকার রং। গ্রন্থের মধ্যরেখা সোনালী, সোনার মতই মূল্যবান শিক্ষার গুণগত মান।
রাবির দীর্ঘ পরিক্রমার বর্তমান :
গত সাত দশকে ক্যাম্পাসের কলেবর যেমন বেড়েছে, তেমনি পঠন পাঠনে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। ৭৫৩ একরের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ১১৭৭ জন শিক্ষক, ৮০৮ জন অফিসার ,৫৯৪ জন সহায়ক কর্মচারী ও ৭৭৬ জন সাধারণ কর্মচারী। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৩৩০ জন (বিদেশি শিক্ষার্থী ৫৮ জন)। এর মধ্যে ছাত্র ২৫ হাজার ৫৭৯ জন ও ছাত্রী ১২ হাজার ৫৫১ জন। বর্তমানে ১২ অনুষদের অধীনে বিভাগ রয়েছে ৫৯টি, ইনস্টিটিউট রয়েছে ৬ টি । বেড়েছে অবকাঠামো। ১৩টি (১ টি বিজ্ঞান ভবন নির্মানাধীন)একাডেমিক ভবনসহ বর্তমানে রাবির ছাত্রদের থাকার জন্য আবাসিক হল রয়েছে মোট ১২টি (শহিদ এইচ এম কামারুজ্জামান হল নির্মাণাধীন)ও ছাত্রীদের জন্য রয়েছে ৮টি( বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হল ও শেখ হাসিনা হল নির্মাণাধীন) । এছাড়া গবেষক ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক ডরমেটরি।
ক্যাম্পাসে স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য :
সত্তর বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ধারণ ও লালন করে আসছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সত্তা। এখানে যেমন রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম বুদ্ধিজীবী শহীদ ড.শামসুজ্জোহার কবর, স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মারক সাবাশ বাংলাদেশ, বিভিন্ন স্মৃতি- স্মারক, ভাস্কর্য – ম্যুরাল তেমনি রয়েছে উন্মুক্ত গ্রন্থ যা বিশ্বজ্ঞানের প্রতীক।
শহীদ মিনার কমপ্লেক্স: এখানে আছে রাবি শহীদ মিনার, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা দুটি মুরাল ও উন্মুক্ত মঞ্চ। উল্লেখ্য, এটি একটি ওয়াই ফাই জোন।
সাবাশ বাংলাদেশ: মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সাবাশ বাংলাদেশ ভাস্কর্যটি সিনেট ভবনের দক্ষিণ চত্বরে। প্রয়াত শিল্পী নিতুন কুণ্ডুর তৈরি এই ভাস্কর্যের পাদদেশে একটি মুক্ত মঞ্চ আছে।
বিদ্যার্ঘ: মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ গণিত বিভাগের শিক্ষক হবিবুর রহমান স্মরনে “বিদ্যার্ঘ” স্মারকসৌধটি নির্মিত হয়। এটি শহীদ হবিবুর রহমান হল চত্বরে অবস্থিত।
স্ফুলিঙ্গ: উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ডঃ শামসুজ্জোহা স্মরনে নির্মিত স্ফুলিঙ্গ ভাস্কর্যটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বপাশে শহীদ শামসুজ্জোহা হল প্রাঙ্গণে অবস্থিত।
সুবর্ণ জয়ন্তি টাওয়ার: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তির স্মারক এই সুবর্ণ জয়ন্তি টাওয়ার। প্রধান ফটক পেরিয়ে সড়ক দ্বীপের ডানে, প্রশাসন ভবনের সামনে গোল চত্বরের দক্ষিণপূর্বে।
বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলের প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ অবস্থিত।
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের কাছে এই ফলকটি অবস্থিত।
মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়:
প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হানাদার বাহিনীর হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার শহিদ হওয়ায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বার যুক্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক হবিবুর রহমান, মীর আবদুল কাইয়ুম, সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাড়াও ৩০ জন ছাত্র, কর্মকর্তা ও কর্মচারী শহিদ হন।মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল মান্নান আখন্দ, শাহজাহান আলী, বাংলা বিভাগের আমীরুল হুদা জিন্নাহ, এমএসসি ছাত্র গোলাম সারওয়ার খান সাধন, রসায়ন বিভাগের প্রদীপ কুমার রাহা, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র মোহাম্মদ আলী খান, পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্র মিজানুল হক।
রাবিকে সমৃদ্ধ করে বরেণ্য যারা :
সুদীর্ঘ ৭০ বছরের পথচলায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা নিয়ে অনেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান রেখেছেন। দীর্ঘ এ সময়ে রাবি তৈরি করেছে অনেক দেশবরেণ্য, জ্ঞানতাপস, ভাষা বিজ্ঞানী সাহিত্যিক। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম, তাত্ত্বিক ও সমালোচক বদরুদ্দীন উমর, চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম, নাট্যকার মলয় ভৌমিক, মাসুম রেজা ও ক্রিকেটার আল আমিন হোসেন প্রমুখদের মতো অসংখ্য গুণীজনকে।
লক্ষ-লক্ষ শিক্ষার্থীর আবেগ, অনুভূতি আর ভাবাবেগের সমস্ত জুড়ে আধিপত্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই আবেগের মধ্যমনি হিসাবে জায়গা দখল করে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড, নীল -সাদা বাস, জোহা চত্বর, মতিহার উদ্যান । টুকিটাকি চত্বর, শহিদ মিনার গার্ডেন, ইবলিশ চত্বর বদ্ধভূমি, ভকেট চত্বর, পরিবহন মার্কেট সহ ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে হাজারো স্বপ্নবাজের পদচারণায় দিবারাত্র মুখর থাকে ।
নানা নানা চড়াই-উৎরাই আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মেলবন্ধনে গড়া ভালোবাসার আরেক নাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আগামী প্রজন্মের জন্য সগৌরবে বজায় থাক বিদ্যাজননী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাক মতিহারের এই সবুজ চত্বরে। দেশ,কাল , ভাষা আর সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে উঁচু মস্তকে বিশ্ব-জ্ঞানের দীপ্তি ছড়াক প্রিয় রাবি, জন্মলগ্নের শুভক্ষণে এটাই প্রত্যাশা।