পাবলিকের অধীনে সরকারি কলেজ মন্ত্রণালয়ের চাপ, ইউজিসির নীরবতায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনীহা
পাবলিকের অধীনে সরকারি কলেজ
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের(এনইউ) অধীনে থাকা সরকারি কলেজগুলোকে অঞ্চলভিত্তিক পাবলিক বা রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আট বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা সামনে দাঁড় করিয়ে বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার বিকাশ ও গবেষণায় ভূমিকা রাখতে পারছে না। আর শিক্ষক সংগঠনগুলোর দাবি, সরকারি কলেজগুলোর শিক্ষকরাও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাঠদানে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বিপরীতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র সনদ বিতরণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যার ফলে, ব্যাহত হচ্ছে উচ্চশিক্ষার প্রদানের মতো গুরু দায়িত্ব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষক সংগঠনগুলো বা তাদের রাজনীতির অব্যাহত ফলাফলের সমাধান হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাচ্ছেন পড়াশোনার গুণগত মানের শিক্ষা ও ব্যবস্থা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ গত ১৩ এপ্রিল এক নির্দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পাবলিক বা রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় কোন কোন সরকারি কলেজ পড়তে পারে; তার একটি তালিকা প্রস্তুত করতে। সর্বশেষ তথ্য বলছে, যার অগ্রগতি হয়নি খুব বেশি। এছাড়াও, মন্ত্রণালয় থেকে ইউজিসিকে সরকারের ‘উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত’ বাস্তবায়নের জন্য তাগাদা দেয়া হয়েছে চলতি বছরের ৬ জুলাই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত করতে হবে- মর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দেন ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট। তখন বেশ আগ্রহ নিয়ে রাজধানীর সাতটি বড় সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষার্থীদের বড়ো প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় হলেও খুব বেশি সমাধান হয়নি সেশনজটসহ চলমান নানা সমস্যার। তখন সাত কলেজের অধিভুক্তি হলেও থমকে যায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোর অধিভুক্তির প্রক্রিয়া।
এছাড়াও, ২০১৫ সালের ১২ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সীমিতকরণ কিংবা যৌক্তিক করতে একটি অনুশাসন দিলেও তারও খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যায়নি। তবে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত করতে হবে- এমন সিদ্ধান্ত ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট’ এবং ২০১০ সালের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’র সাথে সাংঘর্ষিক। যদিও, একই নীতিমালা কিংবা নির্দেশনায় ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
তবে নতুন উদ্যোগের পাশাপাশি নতুন বিরোধও তৈরি হচ্ছে। এ নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দিক শক্ত অবস্থানে রয়েছেন অনার্স-মাস্টার্স কোর্স পাঠদানকারী সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করতে। যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সভায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের(এনইউ) শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে প্রকাশ্য মতবিরোধে সবার নজরে আসে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরও (মাউশি) মনে করছে, মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা ও ব্যবস্থাপনায় অবদান রাখতে পারছে না জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। মানসম্মত ও গুণগত উচ্চশিক্ষা উন্নয়নে ব্যাপকভিত্তিক কোন পরিকল্পনাও নেই বলেও জানায় সরকারি কলেজগুলোর নিয়ন্ত্রক এই কর্তৃপক্ষের। তারা বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোন শিক্ষক নেই। তাদের পরিধি বেড়েছে কিন্তু, তাদের সক্ষমতা, ব্যবস্থাপনা ও জনবল না বাড়ায় তারা কোয়ালিটি এডুকেশন দিতে পারছে না। সেজন্য, স্থগিত রাখতে হবে নতুন করে কলেজে অনার্স-মাস্টার্সের পাঠদান অনুমোদন এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের চাপ কমিয়ে বাড়াতে হবে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বলছে এ তদারক সংস্থাটি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের(এনইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-১৯৯২ অনুযায়ী কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধিভুক্ত থাকবে। পরবর্তীতে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে আমাদের আইনি কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে এবং ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। তিনি জানান, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিক আগ্রহের কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের তৎকালীন সেশন শেষ না করেই ঢাবির অধীনে যেতে হয়েছে; যা শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নেবার জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জিং ও বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করে। তবে, পরবর্তীতে, শিক্ষার্থীদের তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলেও জানান তিনি।
অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলছেন, সবগুলো সরকারি কলেজকে দিয়ে দেয়া হবে- প্রধানমন্ত্রীর এই ধরনের নির্দেশনা আমরা কখনো শুনিনি। কিন্তু, মন্ত্রণালয় হঠাৎ করে একটি চিঠি ইস্যু করেছে ইউজিসিকে। যাতে, অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দিয়ে সবগুলো সরকারি কলেজের তালিকা করতে বলা হয়েছে। তিনি জানান, এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হওয়ার কথা ছিল সেটি স্থগিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
যদিও, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য গত আট বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়(এনইউ) ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে(ইউজিসি) নিয়ে বেশ কয়েকবার বৈঠকে বসেছিল। যাতে অবশ্য খুব বেশি উন্নতি হয়নি চলতি অবস্থার।
অন্যদিকে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের(এনইউ) অধীনে থাকতে শিক্ষকরা অনীহা দীর্ঘদিনের। তারা বলছেন, শুধুমাত্র পরীক্ষা নেয়া ও সনদ দেয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের(এনইউ)। তারা উচ্চশিক্ষার মূল ধারণা ও চেতনা থেকে সরে গেছে; জ্ঞান উৎপাদন, জ্ঞান সংরক্ষণ ও জ্ঞান বিতরণের মতো প্রধান ও মূল ধারণাও আড়াল করছে প্রতিষ্ঠানটি। তারা বলছেন, পরীক্ষা নেয়ার নামে এখানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আদায় করা হচ্ছে। এখন এটি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তারা শুধুমাত্র পরীক্ষা নেয়া ও সনদ দেয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এতে এনইউ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে, নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার বিকাশে কোন অবদান রাখতে পারছে না তারা। ফলে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের(এনইউ) অধীনে থাকতে অনেক বেশি অনীহা শিক্ষকদের।
তবে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়(এনইউ) বলছে, সংকট সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে বড়ো পরিসরে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে বড়ো পরিকল্পনার। তাদের দাবি, সেজন্য করতে হবে অঞ্চলভিত্তিক স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়। যাতে অঞ্চলভিত্তিক অন্য কারো সাথে না গিয়ে বরং তারাই তার তদারকি করতে করবে। তারা আরও দাবি করছে তাতে করে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় ‘গুণগত অগ্রগতিও’ আসবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের(এনইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান জানিয়েছেন, একনেকে অনুমোদিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ছয়টি আঞ্চলিক কেন্দ্রের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। পাশাপাশি আরও কয়েকটি আঞ্চলিক কেন্দ্র নির্মাণের পরামর্শ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। ড. মশিউর রহমান আশাবাদী, যদি মোট ৯টি আঞ্চলিক কেন্দ্র নির্মাণ করা যায়, তাতে সমস্যার সমাধানে। তিনি জানান, একেকটি আঞ্চলিক কেন্দ্রের অধীনে মোট দুইশ’ থেকে ২২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পড়বে। এ বিকেন্দ্রীকরণ করা গেলে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করে সমস্যার সমাধান করা যাবে। যা জাতীয় শিক্ষানীতির অনুকূলে থেকে করা সম্ভব বলেও জানান তিনি। এ নিয়ে এখনও কোন নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই মন্ত্রণালয়ের যেকোন সিদ্ধান্ত পালন করবো।
তবে, মন্ত্রণালয়ের চলমান সিদ্ধান্তেও সমাধান হচ্ছে না চলতি সমস্যার। কেননা, বড় কলেজগুলোর অধিভুক্তি করার সক্ষমতা অনেকক্ষেত্রেই ছাড়িয়ে যাবে কিছু সদ্যজাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতাকেও। কারণ, শিক্ষক, শিক্ষার্থীর সক্ষমতায় অনেকক্ষেত্রেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের(এনইউ) চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে স্থানীয় কিছু কলেজ। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ, কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজসহ এমন কলেজগুলো যার অনন্য উদাহরণ।
অন্যদিকে, চলতি সিদ্ধান্তে সরকারি, বেসরকারি কলেজের জন্য ভিন্ন ধরনের নিয়ম প্রস্তাব করেছে মন্ত্রণালয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এবং বেসরকারি কলেজগুলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের(এনইউ) অধীনে সারাদেশে ৭৯৭টি সরকারি-বেসরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে পাঠদান চলমান রয়েছে। চার বছর মেয়াদী অনার্সে গড়ে আটটি ব্যাচ এবং মাস্টার্সে দুটি ব্যাচ থাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের(এনইউ)। তারা শুধুমাত্র অনার্স-মাস্টার্সের পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশ করে, সনদ প্রদান করে। কিন্তু, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়(এনইউ) কলেজগুলোর একাডেমিক কার্যক্রম, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা এবং তাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব উচ্চশিক্ষার মূল ধারণা ও চেতনা, জ্ঞান উৎপাদন, জ্ঞান সংরক্ষণ ও জ্ঞান বিতরণের মতো প্রধান ও মূল ধারণার থেকে অনেকটাই আড়ালে পরিচালিত হচ্ছে।