এমরান হোসেন তানিম, পাবিপ্রবি: পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার ক্যান্টিনের ইজারার মেয়াদ দুই বছর। কিন্তু ইজারার শর্ত কোনরূপ নবায়ন না করেই গত তিন বছর ধরে অবৈধভাবে ক্যাফেটেরিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন পুরাতন ইজারাদার। ক্যাফেটেরিয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ থাকলেও সেগুলোকে তোয়াক্কা করা হতোনা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ নিয়ে ক্যাফেটেরিয়া তত্ত্বাবধায়ক একাধিকবার ইজারাদারের সাথে আলোচনা করলে সেই আলোচনাতেও সারা দেননি ইজারাদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্যের কাছে দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্যাফেটেরিয়ার ইজারাদার পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার ক্যান্টিন ইজারার জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। সেই টেন্ডার পায় পাবনা জেলা ছাত্রলীগের নেতা (এরপরে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি) মিজানুর রহমান সবুজের মামা এবং পাবনা পৌর আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহসিন রেজা খান মামুনের প্রতিষ্ঠান মেসার্স মামুন টেডার্স। মেসার্স মামুন টেডার্সের সাথে ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চুক্তিপত্র স্বাক্ষর হয়। চুক্তিপত্রের শর্তানুযায়ী ক্যাফেটেরিয়ায় দিনে ১৯ প্রকারের খাবার পরিবেশন এবং ক্যাফেটেরিয়ার ক্যান্টিন ভাড়া বাবদ মাসে চার হাজার দুইশত টাকা দেওয়ার কথা। এছাড়াও ক্যান্টিনের বিদ্যুৎ ভাড়া, গ্যাস ভাড়া, মানসম্মত খাবার পরিবেশন, সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা সহ একাধিক শর্ত উল্লেখ আছে। চুক্তিপত্রে বলা হয়েছে, ইজারার মেয়াদ দুই (০২) বছর, দুই বছর শেষ হওয়ার পর পুনরায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইজারা প্রধান করা হবে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালের পরে পাবিপ্রবির ক্যাফেটিরিয়ার ক্যান্টিনের ইজারা নিয়ে কোন বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। সূত্র বলছে, স্থানীয় ঐ আওয়ামীলীগ নেতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ক্যাফেটেরিয়ার ইজারার জন্য নতুন করে বিজ্ঞপ্তি না দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন। পরবর্তীতে দুই বছরের মেয়াদ শেষ করে ঐ আওয়ামীলীলীগ নেতা ইজারার নবায়ন না করেই অবৈধভাবে আরো তিন বছর ক্যাফেটেরিয়া চালিয়েছেন। ক্যাফেটেরিয়া এখনো আওয়ামীলীগ নেতার প্রতিষ্ঠানের অধীনেই চলছে।
সূত্র বলছে, ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাফেটেরিয়া চালানোর পেছনের মূল শক্তি ছিল রাজনীতি। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ক্যাফেটেরিয়ার ইজারাদার মহসিন রেজা খান (মামুন) মৃত্যুবরণ করলে ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্ব চলে যায় তার ভাগিনা এবং পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান সবুজের কাছে।
তবে তিনি ক্যাফেটেরিয়ার ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ঐ আওয়ামীলীগ নেতা ক্যাফেটেরিয়া চালানোর জন্য মৌখিক অনুমতি পেয়েছেন বলে জানা যায়। পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান সবুজ এবং তৎকালীন এস্টেট শাখার উপ-রেজিস্ট্রার জহরুল ইসলাম প্রিন্স বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে এই মৌখিক অনুমতি পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন বলে জানা যায়।
ক্যাফেটেরিয়ার সাবেক এক তত্ত্বাবধায়ক থেকে জানা যায়, ক্যাফেটেরিয়ার নতুন ইজারা অথবা পুরাতন ইজারা নবায়নের জন্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুনকে একাধিকবার অবগত করা হয়েছে কিন্তু তিনি তাতে সাড়া দেননি। এসব বিষয়ে তিনি ঐ তত্ত্বাবধায়কে ক্যাফেটেরিয়া ইজারাদারের সাথে কথা বলে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার উপদেশ দেন। ক্যাফেটেরিয়ার সমস্যা এবং নতুন ইজারার বিষয়ে সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম মোস্তফা খানের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হলেও সেই কমিটি ক্যাফেটেরিয়ার সমস্যা সমাধান করতে পারেনি। একটি সূত্র বলছে, ক্যাফেটেরিয়ার বিষয়ে সাবেক উপাচার্যের ওপর স্থানীয় আওয়ামীলীগ এবং ছাত্রলীগ থেকে চাপ ছিল যার কারণে তিনি ক্যাফেটেরিয়া নতুন করে ইজারা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চুক্তিপত্রের শর্তানুযায়ী ক্যাফেরিয়ার বিদ্যুৎ এবং গ্যাস বিল ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের দেওয়া থাকলেও সেই বিল নিয়মিত পরিশোধ করতেন না তারা। অন্যদিকে প্রতি মাসে চুক্তিপত্রে ক্যান্টিনের যে ভাড়া ধরা হয়েছে সেটি পরিশোধ করতেন না তারা।এদিকে ক্যাফেটেরিয়া নিয়ে শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের অভিযোগের সীমা ছিল না। ক্যাফেটেরিয়ায় বাসি খাবার পরিবেশন, পর্যাপ্ত আইটেম বিক্রি না করা, বেশি দাম নেওয়া, দুপুরের পরেই খাবার শেষ হয়ে যাওয়া সহ ক্যাফেটেরিয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের একাধিক অভিযোগ ছিল। এসব বিষয়ে ক্যাফেটিরিয়ার ম্যানেজারের সাথে কথা বললে মাঝে মাঝেই তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন এবং শিক্ষার্থীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিতেন। পাশাপাশি ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মান নিয়ে শিক্ষার্থীরা ফেইসবুকে লিখলে ছাত্রলীগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হুমকি দেওয়া হতো। ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মান নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে দুইজন সাংবাদিক দুইবার ছাত্রলীগ থেকে হুমকি পেয়েছেন।
এ বিষয়ে ক্যাফেটেরিয়ার নতুন তত্ত্বাবধায়ক ড. একরামুল ইসলাম বলেন, ‘ক্যাফেটেরিয়া নিয়ে অভিযোগ একাধিক। এগুলো আমি নতুন উপাচার্যকে জানিয়েছি। তিনি আশা করি সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নিবেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম আবদুল-আওয়াল বলেন, ‘আমি সমস্যার কথা শুনেছি এবং নিজে ক্যাফেটেরিয়া পরিদর্শন করেছি। আমাকে একটু সময় দিতে হবে, আমি ধীরে ধীরে সব সমস্যার সমাধান করবো।’