The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪

৬১তে পা দিলো ঐতিহ্যের বাঙলা কলেজ

বাঙলা কলেজ প্রতিনিধিঃ  ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে ধারণ করে বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার্থে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি বাঙলা কলেজ। রাজধানীর মিরপুরে ২৫ একর জায়গা নিয়ে যার অবস্থান।

১৯৬২ সালের ১লা অক্টোবর উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে পরিচিত করতে পথচলা শুরু হয় বাঙলা কলেজের।

প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজটিতে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে।
আজ রোববার (১ অক্টোবর) ৬০ পেরিয়ে ৬১ বছরে পদার্পণ করেছে ইতিহাস ঐতিহ্যের এই কলেজটি।
কলেজটিতে উচ্চমাধ্যমিকসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৮৫ সালে কলেজটিকে সরকারিকরণ করা হয় এবং ১৯৯৭ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধিভুক্ত করে কলেজটির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ হতে কলেজটির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধিভুক্ত করা হয়।

১৯৬৪ সালে কলেজটি মিরপুরে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে প্রতিষ্ঠাকালীন বছরে এর ক্লাস হতো নবকুমার ইনস্টিটিউটে রাতের শিফটে।

সরকারি বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠার পিছনে যেসব মনীষীদের অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাদের মধ্যে প্রথমেই যার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য, তিনি হলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তৎকালীন সময়ে তিনি বাংলা একাডেমিতে কাজ করেছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান’ প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে।

১৯৫৯ খ্রিঃ হতে ১৯৬১ খ্রিঃ পর্যন্ত ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কার্জন হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানের বক্তা হিসাবে জনাব কাসেম বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। একটি সভায় তিনি বলেন ‘পশ্চিম পাকিস্তান বহু আগে থেকে উর্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করে উর্দুকে সরকারী ভাষা ও সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যমরূপে গড়ে তোলার সঠিক প্রচেষ্টায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে, উর্দু কলেজকে পাকিস্তান সরকার বিপুল অর্থ ও জমি দিয়ে সাহায্য করেছেন। অথচ এত আন্দোলন সত্বেও বাংলাকে সর্বস্তরে চালু করার উদ্দেশ্যে আমরা বাঙলা কলেজ গড়ে তুলতে পারলাম না। সরকারও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকা পালন করছে।’

সেই সভাগুলিতে তিনি এও বলেছিলেন : ‘সরকার এগিয়ে না আসলে আমরা নিজেরাই অদূর ভবিষ্যতে বাঙলা প্রচলন করে দেখাবার উদ্দেশে বাঙলা কলেজ স্থাপন করব।’

‘বাঙলা কলেজ’ স্থাপনের উদ্যোগকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য ‘বাঙলা কলেজ প্রস্তুতি কমিটি’ গঠন করা হয়। কমিটির প্রথম সভা হয় ১৯৬১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে। পরবর্তী সভাগুলো ১৯ ফেব্রুয়ারি এবং ১৮ জুন একই স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারির সভায় আবুল কাসেম উত্থাপিত প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

প্রস্তাবটি ছিলঃ ‘বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে অবিলম্বে ঢাকায় একটি বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হউক’। অবশেষে ১৯৬২ সনের ৪ মার্চ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অবস্থিত রাইটার্স গিল্ড ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় ‘বাঙলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়।

অধিকাংশ সভায় সভাপতিত্ব করেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যাঁরা এসব সভায় উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁ, কবি জসীম উদ্দিন, কবি গোলাম মোস্তফা, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম, তোফাজ্জল হোসেন, ডক্টর ইন্নাস আলী (পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য), ডক্টর কামালউদ্দীন, টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপাল ওসমান গনি, বাংলা একাডেমির তৎকালীন পরিচালক সৈয়দ আলী আহসান, প্রাক্তন ডিপিআই আবদুল হাকিম, ডক্টর হাসান জামান, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, কবি জাহানারা আরজু, আখতার-উল-আলম (পরবর্তীতে ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) সহ তমদ্দুন মজলিসের আরো বেশ কিছু নেতা-কর্মী।

বাঙলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁ (পরবর্তীতে এডিপিআই ও জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল) সহসভাপতি ও প্রাক্তন ডিপিআই আবদুল হাকিম ট্রেজারার নির্বাচিত হন। অবৈতনিক প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষাবিদ আবুল কাসেম।

বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরুতে শিক্ষিত বাঙালি বিদ্বান ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিরোধিতায় নেমেছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিলো, বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করলে ছাত্র-ছাত্রীরা চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে। এমনকি ‘বাঙলা মৌলবি’ জন্ম হবে বলেও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঙলা মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর অবাঙালি বিহারিরা বাঙলা কলেজ দখল করে নেয়। দীর্ঘ নয় মাস অবরুদ্ধ ছিলো এ কলেজটি। কলেজের সাইনবোর্ড নামিয়ে এ সময় ‘উর্দু কলেজ’ সাইনবোর্ড লাগানো হয়।

মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা বাঙলা কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে অজস্র মুক্তিকামী মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

বর্তমান বিন্যাস অনুযায়ী, কলেজের অভ্যন্তরে বড় গেট ও শহীদ মিনারের মাঝামাঝি প্রাচীর সংলগ্ন স্থানে সেসময় পুকুর ছিলো, যেখানে হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী মানুষকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করত। মূল প্রশাসনিক ভবনের অনেক কক্ষই ছিল নির্যাতন কক্ষ। হোস্টেলের পাশের নিচু জমিতে আটককৃতদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হত। অধ্যক্ষের বাসভবন সংলগ্ন বাগানে আম গাছের মোটা শিকড়ের গোড়ায় মাথা চেপে ধরে জবাই করা হতো, ফলে হত্যার পর এক পাশে গড়িয়ে পড়তো মাথাগুলো, অন্যপাশে পড়ে থাকত দেহগুলো।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়েই বাঙলা কলেজ ও আশেপাশে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলেছে, হয়েছে নারী নির্যাতন। কলেজের বর্তমান বিশালায়তন মাঠটি তখন ছিলো জঙ্গলে ভর্তি। বিজয়ের মুহূর্তে তখন এই মাঠসহ পুরো এলাকা ও কলেজ জুড়ে পড়ে ছিলো অজস্র জবাই করা দেহ, নরকংকাল, পচা-গলা লাশ। বিভীষিকাময় গণহত্যার চিহ্ন ফুটে ছিলো সর্বত্র।

জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশাসনিক ভবনের নিচের রুমগুলোকে টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখানে আটকে রেখে মেয়েদের ধর্ষণ করা হতো,ধর্ষণের পরে হত্যা করে সামনে থাকা জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হতো।

অধ্যক্ষের বাসভবনের যাওয়ার রাস্তার গাব গাছ ও বাসভবনের আশেপাশে থাকা আমগাছের শিকড়ের উপর মানুষ জবাই করা হতো।

কলেজটিতে ১০টি স্থানে গণকবরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে এবং চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩টি স্থানে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বের আনুষ্ঠানিক বিজয় লাভ করলেও ঢাকার মিরপুর হানাদার মুক্ত হয় ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.