নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিঃ স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্ন জয় করা এক কথা নয়। স্বপ্ন অনেকেই দেখে কিন্তু সাধ্যমত পরিশ্রমের অভাবে সেই স্বপ্ন অধরায় থেকে যায়। এবার সকল বাঁধা পেরিয়ে স্বপ্ন পূরণ করলেন টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর থানার আশ্রা গ্রামের অদম্য মেয়ে মনিরা নুসরাত ফারহা। তার বাবা একজন গাড়ি চালক। নুসরাত বর্তমানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে মাস্টার্সে পড়াশোনা করছে। নুসরাত দশ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল। তবে তার বর্তমান আয় লাখ টাকা।
নুসরাতের স্বপ্ন পূরণের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তার এই যাত্রাটা এত সহজ ছিল না। করোনার প্রবল থাবায় পুরো পৃথিবী যখন থমকে গেছে, সেই সাথে থমকে গিয়েছিলো বাংলাদেশের হাজারো পরিবারের আয়। নুসরাত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরিবারে মোট সদস্য সংখ্যা ৭জন। তবে কর্মক্ষম ছিল মাত্র তার বাবা এবং বড়ভাই। তবে একসময় তার বড়ভাইয়ের চাকরী চলে যায়। তখন শুধু তার বাবার উপর নির্ভর হয়ে পড়তে হয় পরিবারের বাকি সদস্যদের। পরিবারের এমন করুণ অবস্থা দেখে নিজের ল্যাপটপ টা বিক্রি করে দিতে হয়েছিল তার। নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও নষ্ট হয়ে যায় তার।
দিশেহারা অবস্থায় তখন, কারো সাহায্য আসছিলোনা তার। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে কাজ করার সুবাধে একসময় স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাদিক হাসান শুভ’র সাথে তার পরিচয় হয়। সেই শিক্ষক তাকে দশ হাজার টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়ে শাড়ী কিনে নিয়ে শুরু করে ব্যবসা।
তার গ্রামের বাড়ী টাঙ্গাইল হওয়ায় কাজ শুরু করে টাঙ্গাইলের শাড়ী নিয়ে। তখনও তার হাতে কোনো মোবাইল ফোন ছিল না । দশ হাজার ৫শ’ টাকার শাড়ী কিনে অফলাইনে বিক্রি করা শুরু করে পরিচিত লোকদের কাছে। ৪৪ দিন পর তার মোট বিক্রয়ের পরিমাণ দাড়ালো ২৮ হাজার ৫শ’ টাকা। সেই থেকে চলতে শুরু হলো তার ব্যবসা। সেসময় কাছের কাছের মানুষের কাছে থেকে মোবাইল ফোন গিফট পেয়ে অনলাইনে কাজ করা শুরু করেন। ফেসবুক পেইজ খুলেন আর নাম দেন ‘সৌজন্যে Mr & Mrs’। ব্যবসা শুরুর মূলধন এবং মোবাইল দুটোই ছিলো তার জীবন বদলানোর জন্য উপহার স্বরূপ তাই সে তার পেইজের নাম এটি দেয়।
ব্যবসার লাভের টাকা যেন খরচ না হয়ে যায়। সেই লাভের টাকা দিয়ে যেন ব্যবসা আরো বড় করতে পারে সেই চিন্তাধারা থেকে যোগ দেন একটা চাকরিতে।
সে সময় লকডাউন থাকায় অনলাইন ক্লাস হতো, অফিসের সবাই অনেক সাপোর্ট দিতো পড়ালেখার জন্য, ক্লাস করার সুযোগও দিতো। এক বছর পর অফলাইনে ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় আর সম্ভব হয়নি তার চাকরি করা।
পরে ব্যবসার দিকে আবার নজর দিয়ে লাভের টাকাকে মূলধন বানিয়ে সেই টাকায় পণ্য নিয়ে বিক্রি করতে করতে আজ তার মোট বিক্রয়ের পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখে।
মনিরা নুসরাত ফারহা বলেন,” আমি আমার ব্যবসার মাধ্যমে বাবা-মা কে সাপোর্ট আগের থেকে বেশী পরিমাণে দিতে পারছি। বাবা মায়ের জমি বাঁচাতে ৯০ হাজার টাকা ধার করেছিলাম সেটা এই বিজনেসের লাভের অংশ থেকে শুধরে দিয়েছি। আমার এই অব্দি আসার পেছনে সাদিক স্যারের অবদান অনস্বীকার্য, আমার কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়েই স্যার বেঁচে থাকবেন। আপনাদের সকলের কাছেও আমি দোয়া চাই,নিজের একটা অবস্থান তৈরি করতে চাই আমি। চাকরি করতে চাইনা, চাকরি দিতে চাই।”
তিনি আরও বলেন, “যে ফেইসবুকে সবাই টাকা খরচ করে সেই ফেইসবুক থেকে আমি ইনকাম করি এবং এই ফেইসবুক কে কাজে লাগিয়ে মানবিক কাজও করছি।আমার গ্রামের মানুষ জন এখন ছেলে সন্তান চায় না, তারা আমার মত একটা মেয়ে চায়।”
উল্লেখ্য, বিজনেসের লভ্যাংশ থেকে ‘অদম্য’ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাহায্যে প্যারালাইজড, এক্সিডেন্ট পা হারানো, পঙ্গু মানুষের জন্য হুইলচেয়ার বিনামূল্যে দেন। এখন পর্যন্ত তিনি ৩৪ টা হুইলচেয়ার প্রদান করেছে, ২টা সেলাই মেশিন দিয়েছে দুইজন নারীকে। একজন কে ভ্যানও দিয়েছেন তিনি। এছাড়া শীতবস্ত্র বিতরণ সহ দুস্থ দের ঘরে খাবার না থাকলে বাজার করে দেন তিনি।
শাকিল বাবু/