রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ প্রকোপ বাড়ছে চোখ ওঠা রোগের। প্রায় প্রতিটি ঘরেই কেউ না কেউ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, ভাইরাসজনিত রোগটি শীত ও গরমের মাঝামাঝি বেশি হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ রোগকে কনজাংটিভাইটিস বলা হয়। রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ার কারণে দ্রুত অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ৭ থেকে ১০ দিন পর চলে যায়। তাই আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শামস মোহাম্মদ নোমান বলেন, চোখ ওঠা একটি ভাইরাল ইনফেকশন। সাধারণত যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যেমন- বয়স্ক ও শিশুদের বেশি হচ্ছে। রোগটি একই সময়ে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন কমিউনিটিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
৭ থেকে ১০ দিন ভোগার পর এটি ধীরে ধীরে নিরাময় হয় জানিয়ে তিনি বলেন, যেখানে মানুষের ভিড় বেশি সেখানে রোগটি বেশি ছড়ায়। এটি একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ায়। বছরের যে কোনো সময়, যে কারো এটি হতে পারে। তবে নির্দিষ্ট সময় শেষে রোগী সুস্থ হয়ে যায়।
লক্ষণ
চোখের নিচের অংশ লাল হয়ে যাওয়া।
চোখে ব্যথা, খচখচ করা ও অস্বস্তি অনুভব করা।
প্রথমে এক চোখ আক্রান্ত হয়, পরে অন্য চোখে ছড়িয়ে পড়ে।
চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে।
চোখ ফুলে লাল হয়ে যায়।
চোখ চুলকাতে থাকে। চোখে আলো পড়লে খুব অস্বস্তি লাগে।
প্রতিরোধের উপায়
অসুস্থ ব্যক্তিকে পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা থাকতে হবে জানিয়ে ডা. শামস মোহাম্মদ বলেন, যার চোখ ওঠা সমস্যা দেখা দিবে, সে পরিবারের অন্যদের থেকে সে আলাদা থাকবে। অসুস্থতার মধ্যে অন্য ইনফেকশন হলে রোগীর জটিলতা তৈরি হয়। এজন্য এ সময়ে আলাদা জীবন-যাপন করলে নিজে এবং অন্যরা ভালো থাকবে।
অসুস্থ অবস্থায় সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়ে এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, শিশুর কনজাংটিভ হলে বিদ্যালয়ে না পাঠানো, কর্মজীবী হলে কর্মস্থলে না যাওয়া। এতে দ্রুত পরিত্রাণ মিলবে।
জনবহুল স্থানে দ্রুত ছড়ায়
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের গ্লুকোমা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফতেখার মো. মুনির বলেন, চোখ ওঠা রোগকে ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস বলা হয়। এটা সিজনাল একটি রোগ। ঋতু পরিবর্তনের ফলে ভাইরাল ইনফেকশন হচ্ছে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হিউমিডিটির (বাতাসে থাকা পানির মাত্রা) পরিবর্তন হয়। হিউমিডিটি বেশি হলে ভাইরাল রোগগুলো বেশি ছড়িয়ে পড়ে। এটি ছোঁয়াচে রোগ। বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এ রোগে কেউ আক্রান্ত হলে দ্রুত অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র অন্যজনে ব্যবহার করার কারণে সংক্রমণ বেড়ে যায়। যেমন- বাসার তোয়ালে, বালিশ এগুলো একে অন্যেরটা ব্যবহার করে। স্কুলে বাচ্চারা একেবারে গাদাগাদি করে বসে। ফলে একজন আক্রান্ত হলে অন্যরা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ সংক্রমণটি দ্রুত ছড়ায়। তবে এটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না।
আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলেন, এ রোগে আক্রান্ত হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কম বেশি সকলের এ রোগ হয়ে থাকে। যেহেতু এটি ভাইরাল রোগ, তাই নির্দিষ্ট জীবন চক্র শেষে ভাইরাসটি শেষ হয়ে যায়।
সর্তকতা
আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত তোয়ালে, বালিশ, খাবারের প্লেট ও পানির গ্লাস আলাদা করতে হবে।
চোখে যাতে সরাসরি আলো না পড়ে, এজন্য সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে।
চোখে ঠাণ্ডা শেক দিতে পারেন।
চোখ চুলকাবেন না।
এক চোখে সমস্যা দেখা দিলে অন্য চোখকে সংক্রমণ থেকে নিরাপদে রাখতে হবে।
আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ পরিহার করতে হবে।
হ্যান্ডশেকের মাধ্যমেও অন্যরা আক্রান্ত হতে পারেন। তাই হ্যান্ডশেক করার পর দ্রুত হাত ধুয়ে ফেলুন। নোংরা হাতে কখনোই চোখে হাত দেবেন না।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর চোখে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
চোখে সাবধানে টিস্যু বা নরম কাপড় দিয়ে মুছে নিতে হবে। ব্যবহার করা সেই টিস্যু বা কাপড় সাবধানে নিরাপদ স্থানে ফেলতে হবে, যাতে এ রোগ অন্য কারো না হয়।
চিকিৎসা
চোখের নিচের অংশ লাল হয়ে গেলে, চোখে ব্যথা করলে, খচখচ করা বা অস্বস্তি লাগলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. ইফতেখার মুনির। সেই সঙ্গে দিয়েছেন, নিম্নোক্ত চিকিৎসার পরামর্শ।
এন্টিবায়োটিক ড্রপ ব্যবহার করতে হবে, যাতে অন্যকোন ব্যাকটেরিয়া না ঢুকতে পারে।
ঘনঘন ড্রপ দিলে চোখের ময়লা বের হয়ে যাবে, এতে রোগীর আরাম লাগবে।
ব্যথা থাকলে পেইন কিলার হিসেবে প্যারাসিটামল খাবেন।
একই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হাসান বলেন, এ রোগটি সিজন পরিবর্তনের সময় বেশি হয়। সিজনটা যেহেতু পরিবর্তন হচ্ছে, তাই এ সময় চোখে যাতে ধুলাবালি প্রবেশ না করে, ধোঁয়া না লাগে ও কেমিক্যাল না ঢুকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
এ রোগ নিরাময়ে ওষুধের তেমন প্রয়োজন হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, বারবার চোখ পরিষ্কার করতে হবে। যদি ইনফেকশন হয়, তাহলে এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। সাধারণত কিছু দিন পর রোগটি এমনিতেই সেরে যায়। তবে চোখে দেখতে অসুবিধা হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।