২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করে এবং পরের বছর ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার। নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে উপাচার্যের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ক্যাম্পাস প্রতিনিধি এস এম মানজুরুল ইসলাম সাজিদ।
রাইজিং ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
ড. মো. নাছিম আখতার: মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টা আনন্দের ছিল। এই সুযোগটা আমার জন্য একটা পরীক্ষা। সুযোগ তখনই আসে যখন কারও উপরে আস্থা রাখা হয়। আমার উপর বিশ্বাস করে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা আমার লক্ষ্য ।
রাইজিং ক্যাম্পাস: অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা কতটা চ্যালেঞ্জিং?
ড. মো. নাছিম আখতার: অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অস্থায়ী ক্যাম্পাস পাওয়াটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। চাঁদপুরের চারতলা-পাঁচতলা বিল্ডিংগুলোর রুম ছোট হওয়ায় ক্লাসরুম,কমনরুম,অফিসরুম করার উপযুক্ত ছিলো না।আবার অনেকেই বাসা ভাড়া দিতে রাজি হয়নি,এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছি। আমি মনে করেছিলাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু না হলে আমাদের যে ৯০টা আসন রয়েছে তা ফাঁকা থাকবে এবং ৯০ জন শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়া থেকে বঞ্চিত হবে ফলে তারা বিশ্বজনিন শিক্ষার সাথে যুক্ত হতে পারবে না।তাই আমি খুব দ্রুতই এই অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছি।
রাইজিং ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে আপনি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
ড. মো. নাছিম আখতার: শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রথম শর্ত হল নিরবচ্ছিন্ন একাডেমিক পরিবেশ। যেখানে কোনো ক্লাস বাদ যাবে না,যেখানে কোনো পরীক্ষা বাদ যাবে না।এই নিরবচ্ছিন্ন পরিবেশটা আমি নিশ্চিত করতে পেরেছি। যা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখানকার শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা যথেষ্ট কাজ করেছে। আমি বলেছি সেমিষ্টারের প্রত্যেক কোর্সে যেনো ৩৯ টা ক্লাস হয় এবং শিক্ষকবৃন্দ তা বাস্তবায়ন করছে। আমরা চাই প্রতিটি শিক্ষার্থীর ভিত্তি ভাল হোক যাতে সে নিজেই অনেক কিছু করতে পারে। নিরবচ্ছিন্ন ক্লাস চালমান রাখতে আমরা একাডেমিক ভবন-১ এর পাশাপাশি আরও একটি ভবন ভাড়া নিয়েছি, একাডেমিক ভবন-২ হিসেবে ভবনটিতে শিক্ষা কার্যক্রম কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ক্যাম্পাসে লাইব্রেরি আছে যেখানে পর্যাপ্ত বই রাখা হয়েছে।সকল বিভাগের জন্য কম্পিউটার ল্যাব আছে। আইসিটি, সিএসই পাশাপাশি ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার ল্যাব ব্যবহার করছে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জন্য কম্পিউটার ল্যাবের পাশাপাশি রয়েছে রসায়ন ল্যাব, পদার্থবিজ্ঞান ল্যাব , ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাব। আমাদের শিক্ষার্থীরা কোনো আন্তর্জাতিক সেমিনার, প্রতিযোগিতায় যেতে চাইলে আমি তাদের কে যাওয়ার সহযোগিতা করি এবং নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীরা আইডিয়া কন্টেস্টে সাফল্য এনেছে। শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানব সম্পদে পরিনত করতে প্রয়োজনীয় সকল শিক্ষা উপকরণের সরবরাহ নিশ্চিতের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
রাইজিং ক্যাম্পাস: বর্তমান প্রশাসনের হাত ধরে গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমে কতটা অগ্রগতি হয়েছে?
ড. মো. নাছিম আখতার: আমি নিজে গবেষণায় আছি এবং থাকবো। গবেষণায় সাধারণত তিনটি ধাপ রয়েছে। আমাদের একদম নতুন বিশ্ববিদ্যালয় সেজন্য গবেষণা কার্যক্রমের প্রথম ধাপ রয়েছি অর্থাৎ সাহিত্য পর্যালোচনা ধাপে রয়েছি। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বই পড়ানো মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করছে এবং তথ্যের মাধ্যমে জানাকে সমৃদ্ধ করছে। দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয় তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে , তখন তারা গবেষনার কার্যক্রম সম্পর্কে বোঝে ফলে শিক্ষার্থীরা গবেষণার আইডিয়া তৈরি করতে সক্ষম হয়, সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে গবেষণা পত্র প্রকাশ করা। বর্তমানে আমাদের কোনো শিক্ষক গবেষণা পত্র প্রকাশ করতে ইচ্ছুক হলে এবং পেপার রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রণোদনা চাইলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদেরকে দিয়ে থাকি এবং অলরেডি চাঁবিপ্রবি শিক্ষকরা গবেষণা পত্র লিখছে ও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে প্রকাশ করছে।
রাইজিং ক্যাম্পাস: আপনার বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নে কতটা ভূমিকা রাখবে?
ড. মো. নাছিম আখতার: আমাদের যেহেতু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এখানে তিনটি বিভাগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিক্যালের জন্য ল্যাবের সুবিধা দিয়েছি। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। ভবিষ্যতে এগুলো চলমান থাকবে। আমার টার্গেট বড় বড় কোম্পানির সাথে আমার বিশ্ববিদ্যালয় একটা যোগাযোগ স্থাপন করা, তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করানো যাতে শিক্ষার্থীরা পাশ করার সাথে সাথেই সেসকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকুরী পেয়ে যায়।
রাইজিং ক্যাম্পাস: আপনার বিশ্ববিদ্যালয় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে কেমন ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. মো. নাছিম আখতার: স্মার্ট বাংলাদেশ যে চারটি স্তম্ভ হচ্ছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভার্নমেন্ট,স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনোমি। । আমাদের যে তিনটা বিভাগ রয়েছে সবগুলোই স্মার্ট বাংলাদেশের সাথে জড়িত কারন স্মার্ট সিটিজেন মানে দক্ষ মানব সম্পদ, আর এই দক্ষ মানব সম্পদ নেতৃত্ব দেবে স্মার্ট গভার্নমেন্ট, এই দুটোর সমন্বয়ে তৈরি হবে স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট সোসাইটি। ফলে বলতে পারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্মার্ট বাংলাদেশের একটি পার্ট কারন স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর উচ্চশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী, শিক্ষক রয়েছে তারা গবেষণার মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে। স্মার্ট বাংলাদেশ হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত এবং ই-কমার্স কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বাস্তবায়নের সাথে সিএসই এবং আইসিটি বিভাগ জড়িত এবং ই-কর্মাসের সাথে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ সম্পর্কিত ।
রাইজিং ক্যাম্পাস: শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
ড. মো. নাছিম আখতার: দক্ষতা উন্নয়নে আমরা বিভিন্ন সেমিনার এবং সিম্পোজিয়াম সহ প্রশিক্ষণের আয়োজন করছি। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্লাব গঠনের প্রক্রিয়া চলমান আছে। আমাদের সীমাবদ্ধতার ভিতরে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
রাইজিং ক্যাম্পাস: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদস্থ প্রশাসক হয়েও কেনো সাদামাটা জীবনযাপন বেছে নিয়েছেন?
ড. মো. নাছিম আখতার: বিলাসিতার মধ্যে তো কোন সৃষ্টি নেই, যে দেশগুলো বিলাসী বেশি সেই দেশগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে । আমি জমিতে কৃষি কাজ করে কায়িক পরিশ্রম করি , ফলে আমি মাটির সাথে মিশে যেতে পারছি।কায়িক পরিশ্রম করলে মানসিক অবসাদ দূর হয়, শরীর রোগমুক্ত থাকে এজন্য আমি নিজে কৃষি কাজ করি। আর আমি বিলাসিতা পছন্দ করি না।মানুষের শরীরটা তৈরি হয়েছে পরিশ্রমের জন্য ।
রাইজিং ক্যাম্পাস: চাঁবিপ্রবির একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে কিভাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করছেন?
ড. মো. নাছিম আখতার: একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে কাজ করে যাচ্ছি বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে। আমার বেশির ভাগ জিনিস G2G অর্থাৎ গভার্নমেন্ট টু গভার্নমেন্ট মাধ্যমে ক্রয় করে থাকি ফলে এখানে অনিয়মের কোন সুযোগ থাকে না।আর নিয়োগের ক্ষেত্রে আমার দায়িত্ববোধ থেকে কাজ করেছি কারন অনিয়মের মাধ্যমে অদক্ষ জনশক্তি নিলে কখনো দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব না। শিক্ষকতা হলো একটি মহান পেশা আমি এই পেশাকে কুলশিত করতে চাই না। আর চাঁদপুর হলো আমার মাতৃভূমির একটা অংশ তাই এই অংশটার সমস্যা হোক তা আমি মানুষ হিসাবে মেনে নিতে পারি না। স্বচ্ছতার মাধ্যমে কাজ করলে বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়াবেই দাঁড়াবেই।
রাইজিং ক্যাম্পাস: নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করা চাঁবিপ্রবিকে অদূর ভবিষ্যতে আপনি কী অবস্থায় দেখতে চান?
ড. মো. নাছিম আখতার: মানুষ স্বপ্ন নিয়েই বাঁচে।প্রথম উপচার্য হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে আমার স্বপ্ন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমার যা করণীয় তা আমি সর্বোচ্চ দিয়ে করবো। আমার বিশ্বাস পরবর্তীতে যে প্রশাসন আসবে সঠিকভাবে কাজ করলে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে । আমার প্রত্যাশা একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিবে।
রাইজিং ক্যাম্পাস: তরুণ প্রজন্মের প্রতি আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
ড. মো. নাছিম আখতার: আমাদের বাংলাদেশের একটি বড় অংশ হচ্ছে তরুণ। এই তরুণ প্রজন্মই কিন্তু আগামীতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিবে । তরুণ প্রজন্মকে মুঠোফোন বন্দি না হয়ে মাঠে যেতে হবে, খেলাধুলা করে শারিরীকভাবে কার্যক্ষম হতে হবে। শারিরীকভাবে সুস্থ থাকলে মানসিক শক্তি আসবে, হতাশা কমবে এবং পড়াশোনায় মনযোগ বৃদ্ধি পাবে।