সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডে কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য এবং তাঁদের তিনজন সহযোগীকে দণ্ড দিয়েছেন আদালত। তাঁদের মধ্যে প্রদীপ কুমার দাশ এবং টেকনাফ থানার বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি ছয়জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল সোমবার বিকেলে এ রায় ঘোষণা করেন। কাকে কী অপরাধে সাজা দেওয়া হলো, রায়ে তার বিস্তারিত উল্লেখ করেন বিচারক। রায়ে বলা হয়, ষড়যন্ত্রমূলক ও পূর্বপরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় লিয়াকত ও ওসি প্রদীপ আগাগোড়া নেতৃত্ব দেন।
রায় ঘোষণার শুরুতেই জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘এপিবিএন সদস্যরা স্যালুট দিয়ে চলে যেতে বলার পরও কেন হত্যার ঘটনা থামাতে পারলেন না? তাদের দায়িত্ব ছিল চেকপোস্ট রক্ষা করা। হলে হয়তো এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটত না। এ বিষয়ে এপিবিএন সদস্য এসআই শাহাজাহান আদালতে প্রশ্নের জবাবে উত্তর দেয়, পাশেই একটা গাছের নিচে লিয়াকত দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১০-২০ সেকেন্ডের মধ্যে গুলি করে দেয়। কেন লিয়াকত গুলি করে তা সাক্ষী ও আসামিদের সাক্ষ্য ও জবানবন্দিতে জানার চেষ্টা করি।
পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকতের সাজা দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বিচারক বলেন, সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে উপর্যুপরি গুলি করেন আসামি লিয়াকত আলী। মৃত্যু নিশ্চিত করতে সিনহাকে দেরিতে হাসাপাতালে নিয়ে যায়। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ও হত্যার আলামত ধ্বংস করতে সিনহা ও তাঁর সঙ্গী সিফাতের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে লিয়াকত শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
আর প্রদীপের সাজার কারণ জানিয়ে বিচারক বলেন,সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে আসামি প্রদীপ কুমার দাশ অপর আসামিদের সঙ্গে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করেন। তিনি পূর্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অপর আসামিদের সহায়তায় সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যা করে,বুকে লাথি মেরে পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙে, গলা চেপে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। হাসপাতালে পাঠাতে দেরি করিয়ে, হত্যার দায় থেকে বাঁচার জন্য এবং ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে মামলার আলামত ধ্বংস করে, দুটি মিথ্যা মামলা দায়ের করান।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতের বিষয়ে রায়ে বলা হয়েছে, সিনহাকে হত্যায় সহযোগিতা, ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার জন্য তাঁর গাড়ি থেকে ইয়াবা ও গাঁজা উদ্ধার এবং পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মিথ্যা মামলা করেছিলেন তিনি।
রায়ে বলা হয়, আরেক দণ্ডিত টেকনাফ থানার কনস্টেবল রুবেল শর্মা ওসি প্রদীপের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে হত্যার ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা, সিনহার গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের গল্প বানানো এবং সিনহার সঙ্গীকে নির্যাতন করেছিলেন। আর টেকনাফ থানার এএসআই সাগর দেব ওসি প্রদীপের সঙ্গে ঘটনস্থলে গিয়ে হত্যার ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা, সিনহার গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের গল্প বানানো এবং সিনহার সঙ্গীকে নির্যাতনে জড়িত ছিলেন।
এই পাঁচ পুলিশ সদস্যের বাইরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপর তিনজন নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও নিজাম উদ্দিন পুলিশের সোর্স। রায়ে বলা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে নুরুল আমিনের বিষয়ে বলা হয়েছে, তিনি ওসি প্রদীপের সঙ্গে সিনহা হত্যার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে জড়িত ছিলেন। তা ছাড়া সিনহাকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে হত্যার চেষ্টা, সিনহার সহযোগীদের তথ্য সংগ্রহ এবং প্রদীপকে সহযোগিতা করেছিলেন।
মোহাম্মদ আইয়াজও হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া সিনহাকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে হত্যার চেষ্টা, সিনহার সহযোগীদের তথ্য সংগ্রহ এবং প্রদীপকে সহযোগিতা করেছিলেন। আর নিজাম উদ্দিনও হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, সিনহাকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে হত্যার চেষ্টা, সিনহার সহযোগীদের তথ্য সংগ্রহ এবং প্রদীপকে সহযোগিতা করেছিলেন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এ মামলায় সাতজন বেকসুর খালাস পেয়েছেন। তাঁরাও সবাই পুলিশ সদস্য।